- খাবার সংকটে লোকালয়ে নেমে আসছে হাতি
- হাতির বিচরণে নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেত
- বৈদ্যুতিক ফাঁদে মারা পড়ছে হাতি
- খাবার সংকট দূরীকরণে কলাগাছ রোপণ কর্মসূচি
ভারত সীমান্তঘেঁষা শেরপুরের শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা। এখানে থাকা গারো পাহাড় থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসে বন্যহাতির পাল। ৩০-৪০টি হাতি একসঙ্গে বিচরণ করে বিভিন্ন গ্রামের ফসলের ক্ষেত নষ্ট করে। অনেক সময় দুই থেকে তিনটি পালও পাহাড় হতে নেমে আসে। ফলে নির্ঘুম রাত কাটে কৃষকদের।
কৃষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে তাদের এমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, দিনদিন দখলদারদের হাতে চলে যাওয়ায় বন ছোট হয়ে আসছে। ফলে বনে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। তাই বাধ্য হয়েই হাতি গহিন বন থেকে সমতলে চলে আসছে।
বনবিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের সন্ধ্যাকুড়া, হলদিগ্রাম, গুমড়া, রাংটিয়া এবং কাংশা ইউনিয়নের ছোটগজনী, বড়গজনী ও তাওয়াকুচা এলাকা, শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুড়ি, অফিসপাড়াসহ নালিতাবাড়ী উপজেলার পোড়াগাও ও নয়াবিল ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় দেড় থেকে দুই মাস ধরে হাতির কয়েকটি পাল অবস্থান করছে। দিনের বেলা পাহাড়ি টিলায় ঘোরাফেরা করলেও সন্ধ্যা নামলেই লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, সন্ধ্যাকুড়ায় গোলাপ ও আকাশমণি কাঠের বাগান, সবজি ক্ষেত ও ধানের জমিতে নেমে আসছে হাতির দল। মশাল জ্বালিয়ে ও হইচই করে স্থানীয়রা হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করলেও ফসলের ক্ষতি ঠেকানো যাচ্ছে না।
সন্ধ্যাকুড়া গ্রামের কৃষক মো. দেলোয়ার বলেন, ‘হাতির পাল আমার ২৫ শতাংশ ধানের জমি নষ্ট করেছে। আমি গরিব মানুষ, সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। হাতির অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। এটার একটা সমাধান চাই।’
নলকুড়া ইউনিয়নের গুমড়া গ্রামের কৃষক আকবর আলী বলেন, ‘আমার বরবটি আর বেগুনের ক্ষেত হাতি নষ্ট করেছে। আমি নিজ চোখে ছোট-বড় হাতি দেখেছি। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। হাতির কারণে আমরা খুব চিন্তায় আছি।’
একই গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গারো পাহাড়ে হাতির খাবার ও আশ্রয়ের সংকট তৈরি হয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু হাতি এসে আমাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলে, ফসল নষ্ট করে ফেলে। স্থানীয় এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমকে আরও কার্যকর করতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে জঙ্গল ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে গারো পাহাড়ে হাতির বিচরণের জায়গার পাশাপাশি খাবারের সংকট তৈরি হয়েছে। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সীমান্তবর্তী লোকালয়ে। নিজের জায়গায় পরবাসী হওয়া হাতি এখন খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসছে। তখনই দেখা দিচ্ছে বিপত্তি।
আরও পড়ুন
হাতি সম্পর্কে জেনে নিন অজানা তথ্য
সার্কাসের হাতিকে যেভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়
মানুষ-হাতির সহাবস্থান নিশ্চিতে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ
বন্যপ্রাণী অধিকার কর্মী কাঞ্চন মিস্টার মারাক বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই গারো পাহাড়ের নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে হাতির বিচরণক্ষেত্র ছিল। কিন্তু পাহাড়ে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে নানাভাবে মূল্যবান গজারি গাছসহ বন-জঙ্গল সাফ করে ফেলছে। এতে হাতি এখন নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ছে। বনাঞ্চল সংকুচিত হওয়ায় খাদ্যের সন্ধানে হাতি অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসছে।’
বন্যপ্রাণী অধিকার কর্মী সৈয়দা অন্যান্য ফারিয়া বলেন, ‘বন্যহাতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মালিক ও কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে নগদ টাকা ভর্তুকি দিয়ে আসছে বনবিভাগ ও সরকার। এ বছর নালিতাবাড়ীর সমশ্চুরার কৃষক জিয়াউল হকও ৪০ হাজার টাকা ভর্তুকি নেন। এরপরও তিনি তার ধানের জমিতে হাতি মারার জন্য জিআই তারের বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে রাখেন। চলতি বছরের ২০ মার্চ রাতে সমশ্চুরায় ওই বৈদ্যুতিক জিআই তারে জড়িয়ে একটি হাতি মারা যায়। মূলত এখানকার ভূমিগুলো একসময় গহিন বন ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে বসতি স্থাপন করে বনের জায়গায়। ফলে ধীরে ধীরে বনের জায়গা কমে গেছে। ফলে হাতির বাস করার জায়গা সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘শাইন’-এর নির্বাহী পরিচালক মুগনিউর রহমান মনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাতি যাতে দ্রুত এই বনে (গারো পাহাড়) বিলুপ্ত হয়ে যায়, সেজন্য একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে জেনারেটর এবং সরাসরি বিদ্যুৎ দিয়ে জিআই তারের মাধ্যমে হাতি নিধনে নেমেছে। ফলে প্রতিবছরই হাতি হত্যার ঘটনা ঘটছে। গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে এ চক্রকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে এলাকায় জনগণের জন্য বনবিভাগকে সচেতনতামূলক কার্যকরী সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি এটা না হয়, তাহলে বনের হাতি দ্রুতই হারিয়ে যাবে। হাতি না থাকলে এ বনটিও হারিয়ে যাবে। সেইসঙ্গে পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।’
তবে হাতির খাদ্য সংকট নিরসনে গারো পাহাড়ে সুফল বাগান করা হয়েছে বলে জানান ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল করিম।

তিনি বলেন, ‘এ মাসে প্রতিটি বিটে দুই হাজার কলাগাছ রোপণের কর্মসূচি চলছে। এগুলো বড় হলে হাতিদের খাবারের সংকট অনেকটাই কমে যাবে। একই সঙ্গে বনবিভাগ ও ইআরটি সার্বক্ষণিক হাতি পাহাড়ে ফেরাতে কাজ করছে। তবে খুশির খবর, এরই মধ্যে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমে এসেছে।’
ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. দেওয়ান আলী জানান, নালিতাবাড়ীতে বন্যহাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অনুদানের চেক বিতরণ করা হয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর নালিতাবাড়ী উপজেলার মধুটিলা রেঞ্জ অফিসে উপকারভোগী ৩৬ জনের মাঝে অনুদানের চেক বিতরণ করা হয়। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ আইনে তাদের এ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এসময় ৩৬ জনকে মোট ছয় লাখ ৭৩ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবুও মানুষ হাতি দেখলে মারতে আসে। বিভিন্নভাবে ফাঁদ পেতে রাখে।
আরও পড়ুন
হাতি থেকে বাঁচতে মানুষের লড়াই, চায় স্থায়ী সমাধান
মাতৃস্নেহে বেড়ে উঠছে মা-হারা হাতি শাবক যমুনা
গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব চরমে
হাতির ডেরায় মানুষের হানা, আবাসস্থল নিয়ে ‘দ্বন্দ্ব’
রিসার্চ অ্যান্ড কনজারভেশন অব এলিফ্যান্ট বাংলাদেশের সভাপতি আসিফুজ্জামান পৃথিল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দখলবাজরা বনের সম্পত্তি নিজেদের কবজায় নিয়ে হাতিদের জায়গা সংকটে ফেলেছে। হাতি হত্যার সঙ্গে যারা যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।’
তিনি আরও জানান, বিগত সরকারের আমলে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে হাতি তাড়াতে সোলার ফেন্সিং ব্যবস্থা করা হয়। যা চালুর তিনমাসের মাথায় পুরো প্রকল্প ভেস্তে যায়।
দুবাই সাফারি পার্কের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল ওয়াইল্ডলাইফ স্পেশালিস্ট ড. রেজা খান বলেন, ‘হাতি অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের প্রাণী। কিন্তু শেরপুরের গারো পাহাড়ের হাতিদের মানুষ ব্যাপকভাবে বিরক্ত করছে। হাতিগুলো পাহাড়ের নিচের দিকে নেমে আসলেই শত শত উৎসুক মানুষ দেখতে এসে ঢিল ছুড়ে, হৈচৈ করে নানানভাবে হয়রানি করে। সরকারের উচিত একটি বিস্তৃত জাতীয় বন্যপ্রাণী নীতি তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা, যা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, সুরক্ষা এবং টেকসহ ব্যবস্থাপনার জন্য স্পষ্ট কৌশল রূপরেখা দেবে।’
শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাদ্যের অভাবেই হাতিরা লোকালয়ে আসছে। আমরা মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার নির্দেশ দিয়েছি। সীমান্ত এলাকায় হাতির খাদ্য নিশ্চিত করা গেলে তারা লোকালয়ে নামবে না।’
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘গারো পাহাড়ে হাতির আবাসস্থল নালিতাবাড়ীর ধাওদারায় একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই জায়গাটি হাতির বাসভূমি। আমরা জায়গাটি পরিদর্শন করেছি। সেখানে আর পর্যটনকেন্দ্র হবে না। আমরা গারো পাহাড়ের হাতি-মানুষের কথিত দ্বন্দ্ব নিরসনে স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছি।’
এসআর/জিকেএস

1 day ago
6









English (US) ·