শারমিন জাহান মিতা সুনামগঞ্জের টিলাগাঁও গ্রামের মেয়ে। বাবা-মা দুজনই সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। পড়াশোনা করেছেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর বাবা-মায়ের স্বপ্ন ও বিসিএস ক্যাডার স্বামীর অনুপ্রেরণায় বিসিএস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সম্প্রতি তিনি ৪৪তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা (ইংরেজি) ক্যাডার পেয়েছেন।
তার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প, প্রস্তুতি ও নতুনদের পরামর্শ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠা সম্পর্কে বলুন—
শারমিন জাহান মিতা: আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের টিলাগাঁও গ্রামে। প্রত্যন্ত অঞ্চল বলতে যা বোঝায়, আমার গ্রাম হয়তো তার থেকেও একটু বেশি ছিল। প্রতিদিন খাসিয়ামারা নদী নৌকায় পার হয়ে আরও প্রায় ২ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যাওয়া লাগতো। কারণ যাতায়াতের জন্য কোনো যানবাহন ছিল না। বৃষ্টি আর বন্যার সময় তো স্কুলে যাওয়ার কষ্ট ছিল আরও অবর্ণনীয়। গ্রামের নির্মল পরিবেশে বেড়ে উঠলেও এই কষ্টগুলো আজও মনে পড়ে। মা-বাবা দুজনই ছোট স্কেলের সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় সব সময় স্বপ্ন দেখতেন, মেয়ে বড় হয়ে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হবে। পড়াশোনার প্রতি নিজের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর মা-বাবার যথাযথ সমর্থন ও সহযোগিতা আমাকে অজপাড়াগাঁ থেকে এতদূর নিয়ে এসেছে।
জাগো নিউজ: আপনার পড়াশোনা সম্পর্কে বলুন—
শারমিন জাহান মিতা: টেংরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও টেংরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কেটেছে আমার স্কুলজীবন। ২০১১ সালে টেংরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি সম্পন্ন করি। এরপর ২০১৩ সালে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি সম্পন্ন করি। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার দুটোতেই জিপিএ ফাইভ পেয়ে সফলভাবে উত্তীর্ণ হই। ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে পড়বো। কিছু নাম্বারের জন্য মেডিকেলে সুযোগ না পেলেও পরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করি। অনার্সে নিজের ব্যাচে ১ম স্থান অধিকার করি এবং মাস্টার্সে ২য় স্থান লাভ করি।
জাগো নিউজ: বিসিএস দেবেন এমন ভাবনা মাথায় এলো কীভাবে?
শারমিন জাহান মিতা: আসলে অনার্স শেষ করার আগে বিসিএস নিয়ে ভাবিনি। অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ভালো করতে গিয়ে বিসিএসের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। মাস্টার্স শেষ করেই মূলত আমার বিসিএসের দিকে পদযাত্রা। আমার স্বামী তখন ৩৮তম বিসিএস থেকে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত। তখনো তার বিসিএসের জন্য পড়াশোনার ফলশ্রুতিতে তিনি ৪১তম বিসিএস থেকে পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেন। বিসিএসের প্রতি তার এই ডেডিকেশন দেখে এবং বলতে গেলে তার অনুপ্রেরণায়ই আমার বিসিএসের পদচারণা শুরু।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
শারমিন জাহান মিতা: আমার বিসিএস প্রস্তুতির শুরু হয় ২০২১ সাল থেকে। আমি কখনো কোনো কোচিং করিনি। ঘরে বসেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে রুটিন করে পড়াশোনা শুরু করি, আর আমার স্বামীর দেওয়া গাইডলাইন ফলো করি। বিসিএসের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন ধাপ হলো প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। প্রিলিমিনারি পাসের মূলমন্ত্র হলো প্রচুর পড়াশোনা আর রিভিশন দেওয়া। প্রস্তুতির শুরুতে প্রতিদিন রুটিন ফলো করে প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন কমপ্লিট করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। পরীক্ষার ১ মাস আগে থেকে মডেল টেস্ট দেওয়া শুরু করি। আমরা দুজন একসাথে মডেল টেস্ট দিতাম। তিনি যেহেতু ক্যাডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাই তার মার্কসের সাথে আমার মার্কস মিলিয়ে আমার অবস্থান যাচাই করতাম। এই টেকনিকটা আমাকে প্রিলিমিনারি পাসে অনেক সাহায্য করেছে। নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার ফলে ভুল ও নেগেটিভ মার্ক ধীরে ধীরে কমে আসে। ফলে ৪৩তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এরপর বিসিএস লিখিতের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। প্রতিদিন ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং এবং অনুবাদ চর্চা করতাম। পাশাপাশি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি। সহজেই লিখিত পরীক্ষায়ও উভয় ক্যাডারে উত্তীর্ণ হই। এরপর শুরু হয় বিসিএস ভাইভা প্রস্তুতি। নিয়মিত সংবাদপত্র ও সাম্প্রতিক ঘটনা পড়তাম। পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতিও নিয়েছি। নিজেকে সব সময় আত্মবিশ্বাসী রাখার চেষ্টা করেছি। ৪৩তম বিসিএসে নন-ক্যাডার থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পেলেও ৪৪তম বিসেএসে ক্যাডার আসে।
আরও পড়ুন
বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে সময়ের সদ্ব্যবহার করেছি: ফারুক হোসেন
প্রকৌশল ছেড়ে বিসিএস ক্যাডার হলেন তানভীর
জাগো নিউজ: ৪৪তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা (ইংরেজি) ক্যাডার পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন?
শারমিন জাহান মিতা: ৪৪তম বিসিএসের ফাইনাল রেজাল্ট শিটে নিজের রোল যখন দেখতে পাই; তখন অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করেছিল। কতটা নির্ঘুম রাত যে কাটাতে হয়েছে, তা যারা এই পথে হেঁটেছেন কেবল তারাই অনুভব করতে পারবেন। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন সব সময়ই ছিল। ক্যাডার পেয়ে অবশ্যই অনেক খুশি। সবকিছুর জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করি।
জাগো নিউজ: বিসিএস জার্নিতে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
শারমিন জাহান মিতা: বিসিএসের প্রস্তুতির সময় আমাকে কোনোরকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়নি। আমার বিসিএস জার্নি শুরু হয় আমার বিয়ের পর ২০২১ সাল থেকে। অনেকেই আমাকে বলতেন যে, বিয়ে করে ফেললে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। আসলে সৃষ্টিকর্তা সহায় হলে এবং বন্ধুর মতো একজন জীবনসঙ্গী থাকলে বিয়ের পরও নিজের স্বপ্ন পূরণ করা যায়।
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
শারমিন জাহান মিতা: বিসিএস যাত্রার পুরোটাই শুরু হয়েছিল স্বামীর অনুপ্রেরণায়। আমরা দুজন একই ক্যাম্পাস এবং ডিপার্টমেন্টের ছিলাম। তিনি আমার থেকে তিন ব্যাচ সিনিয়র। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অ্যাকাডেমিক সফলতায় তার অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের বিয়ের আগে সেই ২০১৪ সালে আমার গ্র্যাজুয়েশন শুরুর সময় থেকে বিয়ের পর এই পর্যন্ত আমার সব কঠিন সময়ে এই ভদ্রলোক আমার পাশে ছায়ার মতো ছিলেন। নিজের জীবনের যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আজীবন সংশয়ে থাকা আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে আমার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। তিনি আমাকে সব সময়ই বলতেন, ‘লেগে থাকো, তুমি পারবে। সৃষ্টিকর্তা পরিশ্রমীদের নিরাশ করেন না।’ তিনি বর্তমানে ৪১তম বিসিএস থেকে পুলিশ ক্যাডারে কর্মরত। বিসিএস প্রস্তুতির এই কঠিন যাত্রায় আমরা দুজনই একে অপরের অনুপ্রেরণা ও ভরসা হয়ে পরস্পরের পাশে ছিলাম।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
শারমিন জাহান মিতা: বিসিএস পরীক্ষার তিনটি ধাপের মধ্যে প্রিলিমিনারি পাস করা বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন। বিসিএসের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির জন্য এক বছর সময় হাতে নিয়ে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিযোগিতা বেশি হওয়ায় পড়াশোনার গতানুগতিক পদ্ধতি বাদ দিয়ে নিজেকে হতে হবে কৌশলী এবং পরিশ্রমী। সঠিক গাইডলাইন মেনে রুটিন করে পড়লে প্রিলিতে ভালো করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভালো সিরিজের বই কিনে প্রতিটি বিষয় একবার পড়ে শেষ করতে হবে। প্রতিটি বিষয়ের বেসিক ক্লিয়ার থাকতে হবে। পরীক্ষার ২ মাস আগে থেকে বইগুলো বারবার রিভিশন দিতে হবে। যে সাবজেক্টে নিজের দুর্বলতা সেটাতে ফোকাস করতে হবে। নিয়মিত মডেল টেস্ট দিতে হবে। এটি নিজের প্রস্তুতি যাচাই এবং পরীক্ষার হলে সময় ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে। প্রতিদিন কিছু ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং এবং অনুবাদের চর্চা করা যেতে পারে, যা পরে লিখিত পরীক্ষায় ভালো মার্কস পেতে সহায়তা করবে। দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করতে হবে। নতুনদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, সফলতা রাতারাতি আসে না। হাল না ছেড়ে একাগ্রতা এবং অধ্যবসায় দিয়ে মানুষ তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
শারমিন জাহান মিতা: সর্বোপরি নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে চাই। সুযোগ পেলে দেশের বাইরে পড়াশোনা করে নিজেকে আরেকটু সমৃদ্ধ করে এসে দেশের কল্যাণে কাজ করতে চাই। ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে চাই।
এসইউ/জেআইএম

1 hour ago
2








English (US) ·