সানজানা রহমান যুথী
একসময় খেলাধুলার ক্ষেত্র মানেই ছিল ফুটবল, ক্রিকেট, কুস্তি ও বক্সিং। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে প্রসার পেয়েছে কোরিয়ান মার্শাল আর্ট তায়কোয়ান্দো।
এক সময় বাংলাদেশের গুটিকতক মানুষ মার্শাল আর্ট শিখতেন, তবে তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড়ের সংখ্যা যেন হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেছে। কিন্ডারগার্টেনের শিশু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সবার মধ্যেই তায়কোয়ান্দো একটি জনপ্রিয় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি। কিন্তু কেন শিখছেন তারা?
এই মার্শাল আর্টটি মূলত আত্মরক্ষা, শারীরিক ফিটনেস ও মনোবলের উন্নতি করে। তায়কোয়ান্দোর ‘তায়’ মানে পা, ‘কোয়ান’ মানে হাত, আর ‘দো’ মানে পথ বা শৃঙ্খলা। মজার বিষয় হলো ছয় থেকে ৮০ বছর বয়সী যেকোনো নারী-পুরুষের পক্ষে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা সম্ভব। হয়তো এ কারণেই সব বযস ও পেশার মানুষের মধ্যে এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বর্তমানে তায়কোয়ান্দোর জনপ্রিয়তার কারণ কী?
বনানী তায়কোয়ান্দো ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা নুরুদ্দিন হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে তায়কোয়ান্দো শেখার আগ্রহ এখন বেড়েছে। অলিম্পিকে এর অন্তর্ভুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব এর প্রধান কারণ। তাছাড়া শারীরিক সুস্থতা, মানসিক শৃঙ্খলা এবং আত্মরক্ষার কৌশল শেখার জন্য এটি একটি জনপ্রিয় মাধ্যম।
‘এছাড়াও এর গতিশীল ও আকর্ষণীয় কিকের কৌশলগুলো তরুণদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। এটি শারীরিক সুস্থতা, আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শৃঙ্খলা বাড়াতে সাহায্য করে, যা একে অন্যান্য মার্শাল আর্টের চেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে,’ বলেন তিনি।
(ডানে) তায়াকোয়ান্দোর ধাপ শেখার প্রশিক্ষণ। ছবি/ সানজানা রহমান যুথী (বামে) প্রতিযোগিতায় ক্ষুদে খেলোয়াড়। ছবি/প্রেস রিলিজ
আত্মরক্ষার কৌশল শেখার একটি চমৎকার উপায় এই খেলা। বিশেষ করে বর্তমান সমাজে আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা বাড়ায় তায়কোয়ান্দোর মতো মার্শাল আর্ট খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। নুরুদ্দিন জানান, বর্তমানে তাদের ক্লাবে প্রায় ৪০ জন তায়কোয়ান্দো শিক্ষার্থী রয়েছে। দিনকে দিন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে।
নারীদের তায়কোয়ান্দো শেখার কারণ কী? তামিমা নামের এক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, ‘আমি ২০২৩ সাল থেকেই তায়কোয়ান্দো শিখছি। মূলত আত্মরক্ষার জন্যই তায়কোয়ান্দো শেখা। প্রথম দিকে পরিবার, বন্ধুবান্ধব তেমন উৎসাহ না দিলেও বর্তমান তারা পুরোপুরি আমাকে সমর্থন করছে। ভবিষ্যতে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে ইনশাআল্লাহ নিজেকে রক্ষা করতে পারব।’
পেশায় চিকিৎসক সুদীপ্ত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি গত ৬ মাস ধরে তায়কোয়ান্দো শিখছি। তায়কোয়ান্দো চর্চার মাধ্যমে একজন মানুষ হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী, আত্মরক্ষায় পারদর্শী ও সুশৃঙ্খল। নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পাশাপাশি সুশৃঙ্খল জীবনের মধ্যে রাখতেই তায়কোয়ান্দো শেখা।’
তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় জুনায়েদ লাবিব বলেন, ‘২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত কলম্বো আন্তর্জাতিক তায়াকোন্দো চ্যাম্পিয়নশিপে আমি স্বর্নপদক পাই এবং ২০২৪ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক তায়াকোন্দো টুর্নামেন্টে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করি। আমার ইচ্ছা ভবিষ্যতে তায়কোয়ান্দের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করা।’
কলম্বো আন্তর্জাতিক তায়াকোন্দো চ্যাম্পিয়নশিপে গোল্ডেন পদকজয়ী জুনায়েদ। ছবি/প্রেস রিলিজ
তায়কোয়ান্দো খেলার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা কী?
এ বিষয়ে তায়কোয়ান্দো গোল্ড মেডেলিস্ট খেলোয়াড় নুরুদ্দিন হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, `তায়কোয়ান্দো খেলার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো আর্থিক সীমাবদ্ধতা, কারণ ভালো মানের সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের খরচ বেশি।‘
এছাড়া, প্রশিক্ষকের ঘাটতি এবং আধুনিক অবকাঠামোর অভাব একটি বড় সমস্যা। প্রতিযোগিতার সুযোগ কম থাকাও অনেক সময় খেলোয়াড়দের আগ্রহ কমিয়ে দেয়। তবে এত কিছুর মাঝেও শিশু থেকে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ খেলায় যথেষ্ট আগ্ৰহ দেখাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, তায়কোয়ান্দো কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে দারুণ উপকার করে। এটি শারীরিক শক্তি, নমনীয়তা এবং সহনশীলতা বাড়ায়, যা তাদের সামগ্রিক সুস্থতায় সাহায্য করে। একই সঙ্গে একাগ্রতা তৈরি করে, যা পড়াশোনা এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
‘নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক ও মানসিক শক্তি অর্জন করে, যা তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। প্রশিক্ষকের নির্দেশ মানা ও নিয়ম মেনে চলার মাধ্যমে শৃঙ্খলাবোধ গড়ে ওঠে। এছাড়া, বেল্ট বা গ্রেডিং সিস্টেমের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে উন্নতি করার প্রক্রিয়া নেতৃত্বগুণ বিকাশে সাহায্য করে।’
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জন
সম্প্রতি (৯-১০ আগস্ট ২০২৫) থাইল্যান্ডের পাতায়ায় আয়োজিত ৮ম হিরোজ তায়কোয়ানদো আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করেছে। ২৯ সদস্যের জাতীয় দল মোট ৩৬টি পদক জয় করেছে। এর মধ্যে ১২টি স্বর্ণ, ৯টি রৌপ্য ও ১৫টি ব্রোঞ্জ। অংশগ্রহণকারী পাঁচটি ক্লাবের মধ্যে এগিয়ে ছিল বনানী তায়কোয়ানদো ক্লাব, যারা পেয়েছে ৮ স্বর্ণ, ৬ রৌপ্য ও ৬ ব্রোঞ্জসহ ২০টি পদক।
থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক তায়াকোন্দো চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫ এ পদক পাওয়া শিক্ষার্থীবৃন্দ। ছবি/প্রেস রিলিজ
বাংলাদেশে তায়কোয়ান্দের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার বাংলাদেশ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনকে সরঞ্জাম দেয়। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে তায়কোয়ান্দো বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এএমপি/আরএমডি/এএসএম