নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্ব কে দেবেন, জিতলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী

6 hours ago 10

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ২৩৭টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। সেই তালিকার শীর্ষে আছে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাম, যিনি কয়েক বছর ধরেই শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং চিকিৎসাধীন আছেন।

দলটির ঘোষণা অনুযায়ী, বগুড়া-৭, দিনাজপুর-৩ ও ফেনী-১ আসন থেকে লড়বেন খালেদা জিয়া। আর গত কয়েক বছর ধরে দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

কিন্তু দলটির নির্বাচনী প্রচারে কে নেতৃত্ব দেবেন আর নির্বাচনে জিতলে কে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু জানানো হয়নি। ফলে কাকে সামনে রেখে এই নির্বাচনের প্রচারে নামতে যাচ্ছে বিএনপি, সেই প্রশ্ন জোরালো হয়ে উঠেছে।

এর কারণ হলো―একদিকে খালেদা জিয়া অসুস্থ, আবার তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন, তা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেননি তিনি বা তার দল। যদিও সর্বশেষ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ বলেছেন, তারেক রহমান নভেম্বরে দেশে ফিরবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়াকে তিনটি আসনে প্রার্থী হিসেবে রাখা দলটির একটি ‘নির্বাচনী কৌশল’ এবং তাদের ধারণা নির্বাচনে জিতলে সরকার গঠনের বিষয়টিতে তারেক রহমানই নেতৃত্ব দেবেন।

আবার কেউ কেউ বলছেন, তারেক রহমান দেশে না ফেরা পর্যন্ত তার ফেরা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে। সে কারণে বিএনপি নেতৃত্বের জায়গায় খালেদা জিয়াকেই রেখেছেন তিনটি আসনে প্রার্থী করার মধ্য দিয়ে।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলছেন, ‘আমরা আশা করি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নেতৃত্ব দেবেন। নির্বাচনে মাঠে-ময়দানে নেতৃত্ব দেবেন জনাব তারেক রহমান। আর বর্তমান বাস্তবতায় জনাব তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হবেন, এটাই আমাদের চিন্তা।’

ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা তারেক রহমান ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

খালেদা জিয়া নাকি তারেক রহমান

খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রথম অংশ নিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে, তার জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমান এবারই প্রথম নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। যদিও ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু সেই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হয়নি।

আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হওয়ার পর বিএনপির পক্ষ থেকে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

মূলত এরপর থেকে দলীয় কার্যক্রম তাকে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছে, তবে তারেক রহমান এসব কর্মকাণ্ড লন্ডন থেকে পরিচালনা করে আসছিলেন।

এর আগে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বিরাট জয় নিয়ে সরকারে আসার পর তারেক রহমানকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

অনেকে মনে করেন, সেই সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই খালেদা জিয়া কার্যত তখনই তারেক রহমানকে দলের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন।

যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, এ নিয়ে রাজনৈতিক সংকটের মুখে ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি চরম সংকটে পড়েছিল। ওই বছরের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারেক রহমানকে। পরে তার মা খালেদা জিয়াও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

১৮ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তারেক রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয়। এ সময় তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর আগে ১৩টি মামলায় জামিন পান তারেক রহমান।

এরপর ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে। তিনি লন্ডন-যাত্রার আগে তার মা খালেদা জিয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে সুস্থ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত তারেক রহমান রাজনীতির বাইরে থাকবেন।

তবে ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন যে ২০১২ সালে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই সেটি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যেই লন্ডন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তারেক রহমান । একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হলে দলের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব তার হাতেই উঠে আসে।

দলটির সভা সমাবেশে গত কয়েক বছর ধরে নেতাকর্মীদের কাছে তারেক রহমানকেই মুখ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টেই নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডন সফরে গেলে সাত বছর পর সাক্ষাৎ হয় মা ও ছেলের।

কিন্তু দলটির সার্বিক কর্মকাণ্ড তারেক রহমানের নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে, এমনকি লন্ডনে তার সঙ্গে বৈঠকের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তবে দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেক, কারণ তিনি অনেক দিন ধরেই হাসপাতালে বা বাসায় চিকিৎসাধীন আছেন।

তাদের ধারণা ছিল প্রতীকী হিসেবে খালেদা জিয়া হয়তো একটি আসনে থাকবেন আর মূল নেতা হিসেবে তারেক রহমানই হয়তো একাধিক আসনে নির্বাচন করবেন। কিন্তু দলের প্রার্থী ঘোষণার পর দেখা গেল খালেদা জিয়া তিনটি আসনে আর তারেক রহমান একটি আসনে নির্বাচন করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিএনপি এই বার্তাই দিয়েছে যে খালেদা জিয়া এখনো সক্রিয় আছেন এবং তিনিই দলটির শীর্ষ নেতা।

তিনি আরও বলেন, আমার কাছে মনে হয় খালেদা জিয়াকে প্রার্থী করে আনাটা হলো দলটির নির্বাচনী কৌশলের অংশ। দলটির অবস্থান বা নির্বাচন নিয়ে যে অনেক প্রশ্ন এখনো আছে, সে বিষয়ে একটা বার্তা গেছে যে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো অনিশ্চয়তা নেই। আর খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর কৌশল তো আছেই।

তার মতে, তারেক রহমান এখনো দেশে না আসায় তার ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা বা উদ্বেগ এখনো কাটেনি।

লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদও বলছেন, এই অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো তিনটি আসনে নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে প্রার্থী করে বিএনপি বোঝাতে চেয়েছে যে তিনিই এখনো দলনেতা।

তিনি বলেন, নির্বাচন ও সরকারের কে নেতৃত্ব দেবেন, বিএনপির হয়ে তা এখনো পরিষ্কার না। এমনও হতে পারে যে খালেদা জিয়া দলনেতা হিসেবেই থাকবেন, আর দলটি সরকার গঠন করলে তাতে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমান।

যদিও সবকিছুই স্পষ্ট হবে তারেক রহমান দেশে ফিরে আসার পর। কিন্তু তিনি কবে ফিরবেন, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ এখনো জানাতে পারেনি বিএনপি।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

Read Entire Article