নির্মাণ বিধিমালা ও ড্যাপ সংশোধনে জনস্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছেনা

3 hours ago 4

ঢাকার ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের ক্ষেত্রে ঢাকার বাসযোগ্যতা এবং সামগ্রিক জনস্বার্থ, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ প্রাধান্য পাওয়ার কথা। অথচ আবাসন ব্যবসায়ী, ভবন ডিজাইন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের প্ররোচনায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জনস্বার্থ ও ঢাকার বাসযোগ্যতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও ড্যাপ সংশোধনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। বিবেচনাহীনভাবে এলাকাভিত্তিক ও প্লটভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) এবং জনঘনত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক। এতে করে যানজট ও বায়ুদূষণে প্রায় অচল ও মৃতপ্রায় এই শহরের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হবে।

শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) কর্তৃক অনলাইনে আয়োজিত
‘বসবাসযোগ্যতায় তলানিতে থাকা ঢাকার ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধন এর প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্যে ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডি পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজউকের খসড়াকৃত ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় এবং ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা ফার সংক্রান্ত সংশোধন প্রস্তাবনায় পরিকল্পনাবিদদের মতামতের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি, যা অত্যন্ত হতাশাজনক এবং বাসযোগ্য ঢাকা গড়বার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে কাজ করবে। অতীতে বিভিন্ন ব্যবসায়িক স্বার্থগোষ্ঠী শহরের পরিকল্পনা ও ইমারত বিধিমালাকে অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা ক্রমান্বয়ে তলানির দিকে গিয়েছে।

তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশেও ইমারত বিধিমালা এবং ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের নামে ব্যবসায়িক গোষ্ঠী তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠেছে, যা শহরের বাসযোগ্যতা, জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থকে আরও হুমকিতে ফেলবে। এই তৎপরতায় সরকারি কিছু কর্মকর্তার পাশে কতিপয় পেশাজীবীও যোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। পরিকল্পনা পেশাজীবীদের দেওয়া প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব না দিয়ে কাদের প্রস্তাবনায় এবং কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে এই ধরনের পরিবর্তন করা হচ্ছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় আবাসিক ভবনের জন্য মোটা দাগে রাস্তার প্রশস্ততা ও প্লটের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে সর্বনিম্ন ‘এফএআর’ বা ফার মান ৩ দশমিক ১৫ ও সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আবাসিক এ৩ (ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট) শ্রেণির জন্য এই মান সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ২৫ নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ২০২৪ সালের মে মাসে খসড়া ইমারত বিধিমালায় অনুসরণ করা হয়েছে। অথচ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে রাজউক প্রণীত ইমারত বিধিমালার খসড়াতে প্লটভিত্তিক আবাসিক এ৩ ক্যাটাগরির ফার মান ৫ দশমিক ৫ করা হয়েছে, যা প্রায় অবাসযোগ্য ঢাকা শহরের ওপর চাপ মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেবে। অথচ বৈশ্বিকভাবেই ছোট আয়তনের প্লটভিত্তিক আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে ফার মান সাধারণত ১ থেকে ৩ এর মধ্যেই হয়ে থাকে। ড্যাপে এলাকাভিত্তিক ফার ও জনঘনত্ব দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রাজউক। অথচ সেসব এলাকার নাগরিক সুবিধাদি একই থাকছে। গোষ্ঠীস্বার্থে বিধিমালার ফার মান পরিবর্তন শহরের বাসযোগ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ বিবেচনায় নিয়ে ফার মান সাধারণত ১-৩ এর মধ্যে থাকে। অথচ প্রস্তাবিত বিধিমালায় ফার মান সর্বোচ্চ ৬ বা ৭, এমনকি নিয়ন্ত্রণহীন ফার মান প্রস্তাব করা হয়েছে।

আইপিডি আরও বলেছে, নগরের আবাসিক এলাকায় কিংবা মহল্লাকেন্দ্রিক উন্নয়নে ভবনের উচ্চতার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা অতি প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা কৌশল, যার মাধ্যমে পরিকল্পনাগত ও স্থাপত্যগত ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হয়। যা সারা বিশ্বজুড়েই নগর পরিকল্পনায় অনুসৃত। ইমারত বিধিমালায় আবাসিক ভবনের উচ্চতার সীমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বরং ড্যাপে প্রস্তাবিত ন্যূনতম ভূমি আচ্ছাদনের প্রস্তাবনা বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।

অনুষ্ঠানে আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউক বারবার পরিকল্পনার মানদণ্ডের সঙ্গে আপস করে পরিকল্পনা ও ইমারত সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান করছে। মেরুদণ্ডহীন ও দুর্বল এই রাজউকের সংস্কার করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে।

আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, সমগ্র পৃথিবীতেই পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট আইন মেনে রিয়েল এস্টেটকে ব্যবসা করতে হয়। পরিকল্পনাকে শ্রদ্ধা না করে একে নিজস্ব ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রভাবিত করার এই ধরনের অপচেষ্টা হলে দেশে পরিকল্পনা করারই প্রয়োজন নেই।

এসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, পার্ক, খেলার মাঠ, বিদ্যালয় নির্মাণ না করে শহরের জনঘনত্ব বাড়ানো শুধু শহরের ধ্বংসায়নই বাড়াবে।

পরিকল্পনাবিদ মুনিম আব্দুল্লাহ বলেন, নাগরিকদের সম্পৃক্ত না করে শুধু ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে করা সংশোধন কোনোভাবেই শহরের ও মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।

আরএএস/এএমএ/এএসএম

Read Entire Article