নিশীথে মস্তিষ্কের পরিচ্ছন্নতা অভিযান, স্বাস্থ্যে তার অমূল্য অবদান

2 hours ago 3

এখন সে কত রাত ;
এখন অনেক লোক দেশ-মহাদেশে সব নগরীর গুঞ্জরণ হ’তে
ঘুমের ভিতরে গিয়ে ছুটি চায়।
-রাত্রির কোরাস।

জীবনানন্দ দাশ

রাত তিনটা। শহর ঘুমোচ্ছে। সারা দিন খাটুনির পর মানুষজন গভীর ঘুমের ভিতর ছুটি কাটাচ্ছেন। কিন্তু তখনো মস্তিষ্কের ছুটি নেই, তার নিষ্কর্মা বসে থাকার জো নেই। মস্তিষ্ক নীরবে পরিশ্রম করে চলেছে; তার ভেতরে চলছে দিনভর জমে থাকা বিষাক্ত বর্জ্য ধুয়ে-মুছে ফেলার কাজ। যারা এই কাজটা করছে সেই অদৃশ্য পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের নাম গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম ((glymphatic system)। লিম্ফ (lymph) বাংলায় যাকে লসিকা বলে তার জ্ঞান-বিজ্ঞান বহু আগে থেকেই জানা আছে। কিন্তু গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের ধারণাটা খুব পুরোনো নয়। ২০১২ সালে ডেনমার্কের স্নায়ুবিজ্ঞানী মাইকেন নেদারগার্ড ও তার দল প্রথম এ ব্যবস্থার অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম হল মস্তিষ্ক তথা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের (CNS) মধ্যে একটি বিশেষায়িত তরল পরিবহন ব্যবস্থা, যা মূলত ম্যাক্রোস্কোপিক বর্জ্য-ক্লিয়ারেন্স সিস্টেম। এটি কোষগুলির মধ্যে ক্ষুদ্র ফাঁকা জায়গা, যাকে ‘ইন্টারস্টিশিয়াল স্পেস’ বলে, তার ভিতরে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (CSF) পরিবহন করে বিপাকীয় বর্জ্য অপসারণ এবং তরল বিনিময় সহজতর করে, যা স্নায়ুতন্ত্রের স্বাস্থ্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম কাজ না করলে দিনভর জমে থাকা রাসায়নিক বর্জ্য-অ্যামিলয়েড-বিটা (amyloid-β), টাউ (tau) ইত্যাদি মস্তিষ্কে রয়ে যায়, যেগুলোই পরবর্তীতে আলঝেইমার বা পারকিনসনের মতো রোগের বীজ বপন করতে পারে। ড. নেদারগার্ড বলেন, ‘এটা অনেকটা রাতের খাওয়া শেষে ডিশওয়াশার চালিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার মতো। সকালে উঠে দেখবেন, আপনার মস্তিষ্ক একেবারে পরিষ্কার।’

ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা
৭২ বছরের ফরিদা বেগম, যিনি শৈশব থেকেই রাত জাগতে ভালোবাসেন। এখন অনেক পরিচিতজনের নাম ভুলে যান, কথার মাঝখানে থেমে যান। তার মেয়ে ভাবছে এ কি বয়সের স্বাভাবিক ফল, নাকি ভেতরে কিছু জমে উঠছে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, হয়তো এটা গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের গতি কমে যাওয়ার ফল। অন্যদিকে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন ডাক্তার নাদিউজ্জামান খান, যিনি টানা নাইট শিফট রোস্টারের কারণে রাতে মাত্র ৪ ঘণ্টা ঘুমান। তিনি জানেন না, প্রতিদিন তার মস্তিষ্কের ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিভাগ’ অসম্পূর্ণ কাজ ফেলে যাচ্ছে যেন শহরের ময়লা সংগ্রহের ট্রাক গ্যারেজে আটকে আছে। আবার, সরকারি হেড অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মনোজ কুমার রায়ের সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরটা ঝরঝরে লাগে না, তিনি কেমন যেন মানসিক অবসাদ বোধ করেন। এই অনুভূতি কেবল ক্লান্তির অনুভূতি নয়। বিজ্ঞানীরা এখন বিশ্বাস করেন যে এটি একটি লক্ষণ হতে পারে যে আপনার মস্তিষ্কের অনন্য বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, যা গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম নামে পরিচিত, তার নির্ধারিত কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়নি।

লিম্ফেটিক সিস্টেম বনাম গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম
লিম্ফেটিক এবং গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের পার্থক্যটা আরও পরিষ্কার করা যাক। মানবদেহে রক্ত একটি বদ্ধ চক্রের মধ্যে প্রবাহিত হয়, তার বিপরীতে লিম্ফ হল একটি ফ্যাকাশে, জলীয় তরল যা আমাদের টিস্যুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং বর্জ্য, অতিরিক্ত জল ও ব্যাকটেরিয়ার মতো অবাঞ্ছিত আক্রমণকারী বহন করে। এটি ‘লিম্ফ ভেসেল’ নামে পরিচিত পাতলা টিউবের নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে, ‘লিম্ফ নোড’ নামক ‘চেকপয়েন্টে’র মধ্য দিয়ে যায়, যেখানে ক্ষতিকারক জীবাণুগুলো ফিল্টার করা হয়। লিম্ফ বিশেষ ধরনের শ্বেত রক্তকণিকাও বহন করে যা আমাদের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এই সমস্ত ক্ষুদ্র স্রোত অবশেষে একটি বিশাল মহাসড়ক ‘থোরাসিক নালি’ (thoracic duct)-তে মিলিত হয়, যা শরীরের বৃহত্তম লিম্ফ ভেসেল। থোরাসিক নালি পরিষ্কার করা ওই তরলকে শিরার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের রক্তপ্রবাহে ফিরিয়ে দেয়, তাই পরিষ্কারকরণ চক্র আবার শুরু হতে পারে। লিম্ফ এবং এর নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া, আমাদের টিস্যু ফুলে যাবে, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাবে এবং আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ দ্রুত বিষাক্ত হয়ে উঠবে। 

দীর্ঘকাল ধরে একটা প্রশ্ন ছিল যে মস্তিষ্কে তো কোন লিম্ফ নেই, তাহলে মস্তিষ্কের বর্জ্য পরিস্কারকরণের কাজ কে করছে বা কীভাবে সম্পাদিত হচ্ছে? উত্তরটি কেবল ২০১২ সালে এসেছিল, যখন মাইকেন নেদারগার্ড এবং তার দল মস্তিষ্কের নিজস্ব লুকানো ‘প্লাম্বিং সিস্টেম’ আবিষ্কার করেছিলেন। তারা বলেন মস্তিষ্কের বর্জ্য পরিষ্কারকরণের কাজটা করছে গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম। যদি লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম শরীরের বর্জ্য পরিষ্কারক দল হয়, তাহলে গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম হল মস্তিষ্কের নিজস্ব রাতের শিফটের পরিচর্যাকারী। মস্তিষ্ক একটি সূক্ষ্ম অঙ্গ, যা ‘রক্ত-মস্তিষ্কের বাধা’ (blood-brain barrier)-র আড়ালে আবদ্ধ থাকে, তাই সাধারণ লিম্ফ নালিগুলো সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। পরিবর্তে, গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম মস্তিষ্কের বর্জ্য ধুয়ে ফেলার জন্য রক্তনালির পাশাপাশি তরল চ্যানেলের একটি বিশেষ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে - যার মধ্যে আলঝাইমারের বা পারকিনসনসের মতো রোগের সাথে যুক্ত বিষাক্ত প্রোটিনও রয়েছে। এই ‘ধোয়ামোছা’ সবচেয়ে দক্ষতার সাথে ঘটে যখন আমরা গভীর ঘুমে থাকি। পরিষ্কার করা তরল ঘাড়ের মধ্য দিয়ে শরীরের লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে প্রবাহিত হয়, যেখানে এটি অবশেষে রক্তপ্রবাহে যোগ দেয়। এই রাতের পরিষ্কার ছাড়া, ক্ষতিকারক বর্জ্য জমা হতে পারে, যা স্মৃতি, মেজাজ এবং সামগ্রিক মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। সহজ করে বললে, গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম মস্তিষ্কের নিজস্ব ‘ড্রেনেজ সিস্টেম’। সংক্ষেপে, লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম শরীরকে সতেজ রাখে, অন্যদিকে গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম মনকে পরিষ্কার রাখে।

নিদ্রাকুসুম তেল এবং গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম  
একসময় নিদ্রাকুসুম তেলের খুব চল ছিল। ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি এই তেল মাথা ঠান্ডা রাখতে, মাথা ব্যথা কমাতে, চুল পড়া বন্ধ করতে এবং ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে বলে কথিত আছে, অন্তত বিজ্ঞাপনে তাই বলা হত। বাইরে থেকে আমরা দেখি মানুষ ঘুমাচ্ছে। কিন্তু গভীরে, মস্তিষ্কের ভেতরে তখন চলে এক অদৃশ্য কর্মযজ্ঞ। দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রাণী বিশেষত ইঁদুরের ভিতর প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে ঘুমের সময় মস্তিষ্কের তরল প্রবাহে পরিচ্ছন্নতার কাজ হয়ে থাকে, মানুষের ক্ষেত্রে তা শুধু অনুমানই ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এমআরআই প্রযুক্তিতে, কনট্রাস্ট ট্রেসার দিয়ে দেখা গেছে আমাদের মস্তিষ্কেও সেই স্রোত প্রবাহিত হয়, বিশেষ করে গভীর ঘুমের সময়। গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের একটি আকর্ষণীয় দিক হল এটি ঘুমের সময় সবচেয়ে সক্রিয় থাকে এবং জেগে গেলে স্থগিত থাকে। ঘুম যখন নন-আরইএম (blood–brain barrier) পর্যায়ে থাকে অর্থাৎ ঘুম যখন গভীর থাকে তখন মস্তিষ্ক সংকুচিত হয়। ফলে মস্তিষ্কের ‘ইন্টারস্টিশিয়াল স্পেস’ অর্থাৎ কোষগুলির মধ্যকার ফাঁকা স্থান প্রসারিত হয়, প্রায় ৬০% পর্যন্ত; যার ফলে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড অবাধে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং বর্জ্য উপাদানসমূহ ধুয়ে ফেলতে পারে। গবেষকরা আরো বলছেন যে, গভীর ঘুমের সময় নরএপিনেফ্রিন নামের রাসায়নিকের মাত্রা কমে যায়, ফলে ধমনীগুলো ছন্দময়ভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হয় যেন সমুদ্রের ঢেউ বা বেহালার তারে ওঠা-নামা করা সুর। সেই সুরের তালে তালে মস্তিষ্কের নদী বয়ে যায়, ধুয়ে দেয় সমস্ত অবাঞ্ছিত জমাট। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটালি হাউগলান্ড বলেন, ‘এ যেন অর্কেস্ট্রার একজন কন্ডাক্টর (পরিচালক), যেখানে প্রতিটি ধমনী একটি বাদ্যযন্ত্র। সঠিক সুরেই গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের সঙ্গীত বেজে যায়।’

মানব স্বাস্থ্যের জন্য সামগ্রিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব
১.    বর্জ্য অপসারণ এবং নার্ভের ক্ষয় (নিউরোডিজেনারেশন) প্রতিরোধ
গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম অ্যামাইলয়েড-বিটা এবং টাউ-এর মতো বিষাক্ত প্রোটিন অপসারণ করে। অকার্যকর গিম্ফ্যাটিক ক্লিয়ারেন্স এই প্রোটিনগুলির জমা হওয়ার সাথে যুক্ত, যা আলঝাইমার এবং পার্কিনসনের মতো নিউরোডিজেনারেটিভ রোগে অবদান রাখে। 
২.    হোমিওস্ট্যাসিস (শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ স্থিতিশীল এবং ভারসাম্যপূর্ণ রাখার ক্ষমতা) এবং পুষ্টি বিতরণ
বর্জ্য অপসারণের বাইরে সিস্টেমটি মস্তিষ্কজুড়ে গ্লুকোজ, লিপিড, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং নিউরোট্রান্সমিটার পরিবহনকে সহযোগিতা করে; তাছাড়া ভলিউম ট্রান্সমিশন এবং কোষের সাধারণ কার্যক্রমকে সহায়তা করে।
৩.    ঘুম-নির্ভরশীল কার্যকলাপ
গভীর ঘুমের সময় গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম সবচেয়ে সক্রিয় থাকে। ঘুম ইন্টারস্টিশিয়াল স্পেস এবং তরল চলাচলকে উন্নত করে, বর্জ্য অপসারণকে সহজতর করে; ঘুমের অভাব এর কার্যকারিতা ব্যাহত করে, সম্ভাব্যভাবে ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রষ্টতা)-র ঝুঁকি বাড়ায়। 

মস্তিষ্কের রাতের নদী কীভাবে প্রবাহিত হয়

১.    পেরিভাসকুলার পাথওয়ে দিয়ে প্রবাহ:
মস্তিষ্কের ভেন্ট্রিকলে, মেরুদণ্ডের কেন্দ্রীয় চ্যানেলে এবং মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের চারপাশের সাবঅ্যারাকনয়েড স্থানে এক ধরণের স্বচ্ছ, জলীয় পদার্থ থাকে, যাকে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ/CSF) বলে, যা মস্তিষ্ক এবং মেরুদন্ডকে সুরক্ষা প্রদান করে। সিএসএফ মস্তিষ্কের রক্তনালির চারপাশের ফাঁকা স্থান দ্বারা গঠিত ক্ষুদ্র চ্যানেলগুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যাকে পেরিভাসকুলার স্পেস (বা ভার্চো-রবিন স্পেস) বলা হয়। অর্থাৎ সিএসএফ পেরিভাসকুলার স্পেস ধরে মস্তিষ্কের টিস্যুতে প্রবেশ করে ধমনী (artery)-র চারপাশে তরল-ভরা টানেল সৃষ্টি হয়।

২.     অ্যাস্ট্রোসাইট (Astrocytes) এবং অ্যাকোয়াপোরিন-৪ (AQP4) চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ:
অ্যাস্ট্রোসাইট হল মস্তিষ্ক এবং মেরুদন্ডের তারা আকৃতির সহায়ক কোষ যা নিউরনকে পুষ্টি জোগায় ও ‘রক্ত-মস্তিষ্কের বাধা’ বজায় রাখে। মস্তিষ্কের রক্তনালিগুলের বাইরের পৃষ্ঠকে অ্যাস্ট্রোসাইট এক্সটেনশনের (প্রান্ত-পা) অগ্রভাগ শক্তভাবে ঢেকে রাখে এবং একটি (শার্টের) হাতা-সদৃশ স্তর তৈরি করে, যা তরল চলাচল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অ্যাস্ট্রোসাইটের প্রান্ত-পাগুলি অ্যাকোয়াপোরিন-৪ চ্যানেল দিয়ে ঘেরা থাকে; এগুলো আসলে ‘প্রোটিন-ছিদ্র’ (protein pore), যা জল এবং সিএসএফকে ভিতরে এবং বাইরে যেতে দেয়।

৩.    পেরিভেনাস ড্রেনেজের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ
একবার সিএসএফ ইন্টারস্টিশিয়াল ফ্লুইডের সাথে মিশে গেলে, এটি বর্জ্য পদার্থ (ক্ষতিকারক প্রোটিনসহ) ধারণ করে ফেলে এবং পেরিভাসকুলার (রক্তনালীর চারপাশে) পথ ধরে বহন করে, অবশেষে মেনিনজিয়াল লিম্ফ্যাটিক ভেসেল (মস্তিষ্কের আবরণের রক্তনালী) ও ঘাড়ের (সার্ভিকাল) লিম্ফ নোডের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যায় এবং ‘ইন্টার্নাল জগুলার শিরা’র মাধ্যমে শিরা ব্যবস্থায় প্রবেশ করে। এই শিরাই ঐ প্রবাহকে ‘থোরাসিক নালি’তে নিয়ে যায় এবং শরীরের সাধারণ লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের মাধ্যমে চ‚ড়ান্ত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে। ড. নেডারগার্ড তাই বলেন, ‘গভীর ঘুম মানেই মস্তিষ্ক থেকে আবর্জনা বের হয়ে যাওয়া। যদি আপনি সেই পর্যায়টি এড়িয়ে যান, তাহলে আপনি আবর্জনা স্তূপ করতে দিচ্ছেন এবং মস্তিষ্ক বিশৃঙ্খলা ঘৃণা করে।’ 

স্বাস্থ্য, সম্পদ ও জ্ঞান 
‘আগে আগে রাতে ঘুমোতে গেলে, সকাল সকাল ঘুম থেকে জেগে গেলে, স্বাস্থ্য-সম্পদ-জ্ঞান সবই মেলে’ ইংরেজি প্রবাদ বা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের এই লেখাটার মর্মই আসল কথা। গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের আলোচনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভালো ঘুম এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস কেবল আমাদেরকে সতেজতার অনুভ‚তি প্রদান করে না - তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোকে প্রবাহিত রাখে এবং আমাদের জীবনকে, আক্ষরিক অর্থেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। সেজন্য প্রয়োজন: 

১. প্রাকৃতিক ঘুম- প্রতিদিন রাতে একই সময়ে ৭-৯ ঘণ্টা গভীর নিদ্রা।

২. স্ক্রিনের আলো পরিহার- ঘুমের অন্তত আধঘণ্টা আগে ফোন-টিভি বন্ধ। তার চেয়ে বরং মুদ্রিত বই পড়া পড়া উত্তম। স্ক্রিনের সমস্যা হল আলো; মোবাইল ডিভাইসগুলি নীল আলো নির্গত করে যা মেলাটোনিন উৎপাদনকে দমন করে, এটা সে হরমোন যা ঘুমিয়ে পড়তে এবং ঘুম গভীর করতে সাহায্য করে। বলা বাহুল্য, মুদ্রিত বই আলো নির্গত করে না, ফলে মেলাটোনিন-দমনকারী প্রভাব ফেলে না। 

৩. শরীরচর্চা ও পানি- রক্তপ্রবাহ ভালো রাখা তথা হৃদরোগের স্বাস্থ্য বজায় রাখা। কায়িক পরিশ্রম, প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট হাঁটা অপরিহার্য। কারণ রক্তনালীর (ধমনী) স্পন্দনই গিম্ফ্যাটিক স্রোতের চালক। 

৪. প্রয়োজন ছাড়া ঘুমের ওষুধ এড়িয়ে চলা - নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, জনপ্রিয় ঘুমের ওষুধ জোলপিডেম (Zolpidem) ইঁদুরের গিম্ফ্যাটিক প্রবাহ প্রায় ৩০% কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ ওষুধে ঘুম এলেও সেই ঘুমে নদীর স্রোত কমে যায়। ফলে পরিচ্ছন্নতার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। এটা যেন বৃষ্টির রাতে তালাবদ্ধ দরজা দিয়ে নদীকে আটকে দেওয়া।

আমরা কেউ কেউ রাতের ঘুম দিনে বেশি করে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। দিনের ঘুম কিছু পুনরুদ্ধারমূলক সুবিধা প্রদান করতে পারে, কিন্তু এটি কোনভাবেই রাতের ঘুমের সম্পূর্ণ বিকল্প নয়। কারণ শরীরের সার্কাডিয়ান ছন্দ (circadian rhythm) - অভ্যন্তরীণ জৈবিক ঘড়ি (biological clock) - স্বাভাবিকভাবেই আলো-অন্ধকার চক্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের সর্বোচ্চ কার্যকলাপ এই ছন্দের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে যে অ্যামাইলয়েড-বিটার মতো মস্তিষ্কের বর্জ্য পদার্থের নির্গমন রাতে ঘটে যাওয়া গভীর ঘুম (deep, slow-wave sleep)-এর সময় সবচেয়ে কার্যকর, যা স্বাভাবিক মেলাটোনিন নিঃসরণ এবং শরীরের তাপমাত্রা চক্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও রাতের বেলায় কাজ করা কর্মীরা দিনের ঘুমের সময় গিম্ফ্যাটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করতে পারেন, তবুও সার্কাডিয়ান অসামঞ্জস্য, বেশি আলোর সংস্পর্শ এবং পরিবেশগত ব্যাঘাতের কারণে দক্ষতা প্রায়শই হ্রাস পায়। এর অর্থ হলো দিনের ঘুমের সাথে রাতের ঘুমের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিস্থাপন মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য এবং বর্জ্য নিষ্কাশন দক্ষতার ক্ষতি করতে পারে।

রাতের ঘুমকে যখন অগ্রাধিকার দেয়া হবে, ভাবতে হবে যে, তা কেবল শরীরকে বিশ্রাম দিচ্ছে না - মস্তিষ্ককে ঘর পরিষ্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিচ্ছে এবং তা করার মাধ্যমে দেহমনকে তরতাজা রাখছে এবং সম্ভবত ভবিষ্যতের দুরারোগ্য ব্যাধি (যেমন আলঝেইমার) থেকে আত্মরক্ষা দিচ্ছে।

নদীমাতৃক দেশ, মস্তিষ্কে নীরবে বহে নদী
আমাদের মস্তিষ্ক যেন পদ্মার তীরে এক আলোকোজ্জ্বল নগরী। দিনে সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি চলে, বাজারে ভিড় জমে, ধোঁয়া আর ধুলা আকাশ ঢেকে দেয়। কিন্তু রাত নামলেই জেগে ওঠে নদী; নিঃশব্দে, ধৈর্যের সাথে, সে বয়ে নিয়ে যায় দিনের সমস্ত ময়লা, বিষ, ক্লান্তি। গিম্ফ্যাটিক সিস্টেম মস্তিষ্কের সেই নদী। যদি এই নদীকে থামিয়ে দেই- দেহ ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারবে না। আর যদি তাকে প্রতি রাতে কাজ করতে দেই- দেহ থাকবে সজীব, প্রাণবন্ত এবং স্মৃতিতে ভরপুর। 

লেখক : বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ
জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, গীতিকার এবং প্রবন্ধকার  
[email protected]

Read Entire Article