নীরব সৌন্দর্যের শহর স্ট্যানলি

9 hours ago 5

পৃথিবীর প্রান্তে এক নীরব সৌন্দর্যের শহর স্ট্যানলি। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী স্ট্যানলি। নামটি উচ্চারণ করলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবীর এক প্রান্তে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো শান্ত উপকূলের ছবি। এক এমন জায়গা, যেখানে সমুদ্রের নোনা বাতাসের সঙ্গে মিশে আছে মানুষের নিঃসঙ্গতা, পাহাড়ের নিস্তব্ধতা আর প্রকৃতির নির্ভেজাল সুর। তিন দিনের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা শেষে যখন দূর থেকে স্ট্যানলির আভা চোখে পড়ল; তখন মনে হয়েছিল যেন নীল সমুদ্রের বুকের ওপর কেউ সাদা তুলোর মতো একটি ছোট্ট শহর এঁকে দিয়েছে, নরম, নির্লিপ্ত, অথচ অদ্ভুতভাবে জীবন্ত।

জাহাজের ডেক থেকে যখন তাকালাম; তখন দেখতে পেলাম ঢেউয়ের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক শহর, যার পেছনে পাহাড়ের কোল, চারপাশে শীতল বাতাসে মিশে থাকা নির্জনতা। এই শহরের জনসংখ্যা মাত্র দুই হাজার, তবুও এটাই পুরো ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের প্রাণকেন্দ্র, রাজধানী, সভ্যতার এক ক্ষুদ্র অথচ গর্বিত প্রতীক। যখন জাহাজ ধীরে ধীরে বন্দরের দিকে এগোচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে এক নিঃশব্দ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছি।

যেই মুহূর্তে আমরা বন্দরে নামলাম, ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসছিল সমুদ্রের নোনতা গন্ধ। দূর আকাশে চিলেরা উড়ছিল সাদা ফিতের মতো, শহরটি দাঁড়িয়ে ছিল পরিপাটি, নিঃশব্দ সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে। রাস্তার ধারে সারি সারি ছোট্ট ঘর-বাড়ি, সবই কাঠের, রঙিন ছাদে ঢাকা। সবচেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য ছিল ইংল্যান্ডের বিখ্যাত লাল টেলিফোন বুথ। লন্ডনের ব্যস্ত রাস্তায় যেমন দেখা যায়, তেমনই এক বুথ এখানে, পৃথিবীর এত প্রান্তে, এই নীরব দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো, ইংল্যান্ডের আত্মা যেন এই ছোট্ট শহরের বুকে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

নীরব সৌন্দর্যের শহর স্ট্যানলি

সবকিছু এত পরিষ্কার, এত শান্ত, চারপাশে যেন সময় থেমে আছে। দোকানপাট গুটিকয়েক, মানুষও হাতেগোনা, কিন্তু প্রত্যেকের মুখে এক ধরনের আত্মমগ্ন শান্তি। এখানকার পোস্ট অফিস, গির্জা, মিউজিয়াম, সবকিছুই এমনভাবে সাজানো, যেন কেউ প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে বরং তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। প্রতিটি জানালার কাঁচে আলো ঝলমল করে, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। মনে হয়, এই শহরে মানুষের নয়, নীরবতারই রাজত্ব।

আমাদের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের শহর উশুইয়া থেকে। সেখান থেকে ফকল্যান্ড পর্যন্ত সমুদ্রপথের দূরত্ব তিন দিনের, তিন দিন মানে তিন রাতের নিরন্তর ঢেউ, দুলে ওঠা জলরাশি, নোনাজলের কুয়াশা আর অনন্ত নীরবতা। এই যাত্রা শুধু ভৌগোলিক নয়, মানসিকও, যেন মানুষ নিজের ভেতরের পৃথিবীটা খুঁজে নিতে বেরিয়েছে। কিন্তু সমুদ্র সব সময়ই কোমল নয়। একদিন সকালে জাহাজের ওপর হঠাৎ প্রবল ঝড় এলো, ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগলো। আমাদের দলের দুইজন সহযাত্রী ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তাই তারা স্ট্যানলিতেই থেকে গেলেন। এখান থেকেই বিমানে ফিরে যাবেন নিজেদের দেশে। তখন বুঝলাম, ভ্রমণ মানে শুধু আনন্দ নয়, এটা ধৈর্যের পরীক্ষা, অভিযানের মূল্য।

স্ট্যানলির বাতাসে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশে তাকালাম, মনে হলো আমরা সত্যিই পৃথিবীর প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এখানে আকাশ অন্যরকম নীল, বাতাসে অন্যরকম সুর। প্রকৃতি যেন এখানে মানুষের প্রতি নির্মমভাবে উদার, সে যতটা শীতল, ততটাই সুন্দর।

ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আসলে দুটি বড় দ্বীপ, পূর্ব ফকল্যান্ড ও পশ্চিম ফকল্যান্ড এবং তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে শত শত ছোট দ্বীপ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, সমুদ্র যেন মুক্তোর মালা পরে আছে। এই দ্বীপগুলো ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলের কাছে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ব্রিটিশ বিদেশি অঞ্চল। তবুও আর্জেন্টিনা আজও দাবি করে, এই দ্বীপ তাদের, নাম দিয়েছে ‘ইসলাস মালভিনাস।’

এই দাবির পেছনে ইতিহাস জটিল ও রক্তাক্ত। ১৬৯০ সালে ইংরেজ নাবিক জন স্ট্রং প্রথম এখানে পা রাখেন। পরবর্তীতে ফরাসি, স্প্যানিশ ও ব্রিটিশ শক্তির মধ্যে পালা করে হাতবদল হয় দ্বীপটির। অবশেষে ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশরা এখানকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে আর্জেন্টিনার জাতীয়তাবাদ আবার জেগে ওঠে, তারা দাবি জানায় মালভিনাস তাদের নিজস্ব ভূমি। সেই দাবির ফলেই ১৯৮২ সালে সংঘটিত হয় ফকল্যান্ড যুদ্ধ, সাত সপ্তাহের ভয়াবহ সংঘর্ষে প্রাণ হারায় বহু সৈনিক, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ বাহিনী পুনর্দখল করে দ্বীপ।

আজও এই যুদ্ধের স্মৃতি বাতাসে ভাসে। গুস গ্রিন ও সান কার্লোসের আশেপাশে আজও দেখা যায় যুদ্ধস্মৃতি, কবরস্থান, লোহার ছাপ। স্থানীয়রা দিনটিকে ভোলেননি, প্রতি বছর ১৪ জুন তারা পালন করে মুক্তি দিবস।

২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে প্রায় শতভাগ ফকল্যান্ডবাসী ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে ভোট দেন। তারা বলেন, ‘আমরা নিজেদের ব্রিটিশ বলেই দেখি।’ এ কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের আত্মপরিচয়ের দৃঢ়তা, তারা হয়তো ভৌগোলিকভাবে দূরে কিন্তু মানসিকভাবে যুক্তরাজ্যেরই অংশ।

ফকল্যান্ডের প্রকৃতি এক অনন্য বিস্ময়। এখানে মানুষের চেয়ে বেশি বাস প্রাণীদের। পাহাড়, প্রান্তর আর উপকূলজুড়ে পেঙ্গুইন, সিল, তিমি, ডলফিন আর অগণিত পাখি যেন নিজস্ব ছন্দে বাঁচে। সবচেয়ে বিখ্যাত হলো পেঙ্গুইন, পাঁচ প্রজাতির পেঙ্গুইন একসাথে দেখতে পাওয়া যায় পৃথিবীতে খুব কম জায়গায় আর ফকল্যান্ড তার একটি। কিং পেঙ্গুইনদের রাজকীয় চলাফেরা, জেন্টুদের দলবদ্ধ দৌড়ঝাঁপ, রকহপারদের পাহাড় বেয়ে ওঠা, সব মিলিয়ে এটি যেন প্রাণীদের এক মহোৎসব।

স্যান্ডার্স দ্বীপে আমরা দেখেছিলাম এই পেঙ্গুইনদের রাজত্ব। শত শত পাখি নিজের মতো করে বাঁচছে, মানুষের উপস্থিতিতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বাতাসে ভেসে আসছিল সমুদ্রের গন্ধ, পেছনে অ্যালবাট্রসদের উড়ে যাওয়া, মনে হচ্ছিল আমরা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।

আরও পড়ুন
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের বিস্ময়কর ভ্রমণ
জিঞ্জা শহর: নীল নদের উৎসের সন্ধান

ফকল্যান্ডের ভূপ্রকৃতি পাথুরে ও ঢেউ খেলানো। পাহাড়ের মাঝে গজিয়ে ওঠা ঘাসে ঢাকা প্রান্তর, দূরে মাউন্ট আসবোর্ন, যার উচ্চতা ৭০৫ মিটার। এখানকার বাতাস পশ্চিম দিক থেকে আসে আর সেই বাতাসেই যেন মিশে থাকে অনন্ত শান্তি। শীতকাল এখানে দীর্ঘ, বাতাস প্রবল, কিন্তু তবুও প্রকৃতি তার সৌন্দর্য কখনো হারায় না।

ফকল্যান্ডের জীবনধারা সরল, আত্মনির্ভর ও পরিশ্রমনির্ভর। রাজধানী স্ট্যানলির বাইরের অঞ্চলগুলোকে স্থানীয়রা বলে ‘ক্যাম্প’। সেখানে বসবাস মানে প্রকৃতির সঙ্গে মুখোমুখি জীবন, ভেড়ার খামার, খোলা আকাশ এবং নীরবতার রাজত্ব। খামারগুলোই ফকল্যান্ডের অর্থনীতির ভিত্তি। যেমন পোর্ট হাওয়ার্ড, প্রায় দুই লাখ একরজুড়ে বিস্তৃত এক বিশাল খামার। এখানে কাজ করে অল্প কিছু মানুষ কিন্তু তাদের দিন কাটে প্রকৃতির ছন্দে।

আরেকটি ঐতিহাসিক স্থান গুস গ্রিন, যেখানে ১৯৮২ সালের যুদ্ধের রক্ত এখনো শুকায়নি। সেখানে ছোট্ট একটি মেমোরিয়াল দাঁড়িয়ে আছে, যেন সময়ের সাক্ষী। আর নর্থ আর্ম, করক্যাস, সি লায়ন, স্যান্ডার্স, ওয়েস্ট পয়েন্ট, এই ছোট ছোট দ্বীপগুলোতে মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা কিন্তু প্রকৃতি এখানে সবচেয়ে উদার। করক্যাস দ্বীপে কোনো ইঁদুর নেই, তাই এটি পাখিদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। সি লায়ন দ্বীপে সারি সারি সমুদ্র সিংহ শুয়ে থাকে সূর্যের তাপ নিতে, তাদের গর্জন শুনলেই বোঝা যায়, প্রকৃতি এখনো এখানে রাজত্ব করছে।

এখানকার আবহাওয়া সবসময় ঠান্ডা, কিন্তু নির্মল। শীতকাল দীর্ঘ, বাতাসে কুয়াশা মিশে থাকে প্রায় সারাবছর। গ্রীষ্ম বলতে অক্টোবর থেকে মার্চ, দক্ষিণ গোলার্ধের উষ্ণতম সময়। তখনই পেঙ্গুইনদের প্রজনন মৌসুম, বাতাসে উষ্ণতার ছোঁয়া আর দিনের আলো থাকে দীর্ঘ সময়। তবে ওজোন স্তর ক্ষীণ হওয়ার কারণে এখানে সূর্যের আলোও তীক্ষ্ণ, সানস্ক্রিন ছাড়া বাইরে যাওয়া বিপজ্জনক। একদিন সূর্য ওঠে উজ্জ্বল, পরদিনই ঘন কুয়াশা ঢেকে দেয় সবকিছু, আবহাওয়ার এই অস্থিরতাই যেন ফকল্যান্ডের চিরন্তন স্বর।

ফকল্যান্ডের সরকারি মুদ্রা হলো ফকল্যান্ড পাউন্ড, যা ব্রিটিশ পাউন্ডের সমমূল্যের। স্ট্যানলির ছোট্ট ব্যাংকে বিনিময় করা যায় এই রঙিন নোটগুলো, প্রতিটি নোটে ছাপা আছে দ্বীপের প্রতীক, পেঙ্গুইন, জাহাজ বা সমুদ্রের ছবি। অর্থনীতি ভেড়ার পশম, মাছ শিকার ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর হাজার হাজার অভিযাত্রী, প্রকৃতিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফার এখানে আসেন, প্রকৃতির নীরব অলৌকিকতাকে নিজেদের চোখে দেখার জন্য।

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ফকল্যান্ডবাসী ব্রিটিশ প্রভাবময় হলেও তাদের হৃদয়ে আছে এক নিজস্ব উষ্ণতা। বছরে তিনটি দিন বিশেষভাবে উদযাপিত হয়, ২১ এপ্রিল রানির জন্মদিন, ১৪ জুন মুক্তি দিবস আর ৮ ডিসেম্বর যুদ্ধ দিবস। দিনগুলোতে শহরের আকাশে পতাকা ওড়ে, ছোট্ট শিশুরা স্কুলের পর একত্র হয়, সৈনিকদের স্মরণ করে, শহরের মানুষ গান গায় স্বাধীনতার সুরে।

রাত নামলে স্ট্যানলির রূপ বদলে যায়। আকাশে নেমে আসে ঘন কুয়াশা, বাতাসে বাজে সমুদ্রের গভীর শব্দ। দূরের পাহাড়ের চূড়ায় তুষাররেখা ঝলমল করে, শহরের আলো নিভে আসে, শুধু লাল টেলিফোন বুথটি যেন একাকী জ্বলে থাকে, ইংল্যান্ডের দূর স্মৃতির মতো। সেই মুহূর্তে বোঝা যায়, স্ট্যানলি কেবল একটি শহর নয়, এটি অনুভূতির নাম, নীরব কবিতা, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরকে ভালোবেসে বেঁচে থাকে।

যখন জাহাজে ফেরার সময় এলো; তখন মনে হচ্ছিল যেন কোনো স্বপ্নভঙ্গের সময় এসেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, স্ট্যানলি তখনও কুয়াশায় মোড়া, লাল টেলিফোন বুথটি দূরে ক্ষীণ আলোয় জ্বলছে। মনে হলো, শহরটি যেন কোনো গল্পের শেষ নয় বরং নতুন সূচনা, এমন পৃথিবীর, যেখানে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় নিঃশব্দতায়, যেখানে সৌন্দর্য শব্দহীন কিন্তু হৃদয়ে গভীরভাবে অনুরণিত।

ফকল্যান্ড শেখায় অদ্ভুত পাঠ, বিশ্বের যত ব্যস্ততা, যত কোলাহল, সবই একসময় দূরে মিলিয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃতি, নীরবতা আর সরলতার সৌন্দর্যই থাকে চিরস্থায়ী। পৃথিবীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই ছোট্ট শহর যেন ফিসফিস করে বলে, ‘সৌন্দর্য সব সময়ই চোখে দেখা যায় না, কখনো কখনো তা কেবল অনুভব করা যায়।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article