ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতাহীন উন্নয়ন টেকসই হয় না

3 weeks ago 7

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থানটি ঘটে গেল ২০২৪ সালের জুলাই– আগস্ট মাসে। ছাত্র -জনতার প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ থেকে জন্ম নেয়া এই অভ্যুত্থানের কারণে বিগত পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটা সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হয়। অথচ বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা আসতো খ্যাতিমান দেশি -বিদেশি গবেষক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকেও।

কেউ বলতো বাংলাদেশের উন্নয়ন নাকি ‘উন্নয়ন ধাঁধা’ (ডেভেলপমেন্ট পাজল), কেউ বাংলাদেশকে সাব্যস্ত করতো উন্নয়নশীল দেশের ‘রোল মডেল’ হিসাবে। স্বভাবতই এসব অভিধার ঝরনাধারায় সেই সময়ের সরকারের তুষ্টি ছিল তুঙ্গে– উন্নয়নের তথাকথিত মহাসড়কে নাকি বাংলাদেশ । কিন্তু এক পর্যায়ে সেই উন্নয়ন ধাঁধা এক গোলকধাঁধার উন্মেষ ঘটিয়ে ‘বিপ্লব’ ঘটালো । বলা চলে, এদেশের আপামর ছাত্র -জনতা বাংলাদেশের উন্নয়ন– বয়ান কে সরাসরি নাকচ করে দিয়ে সরকারকে সরে যেতে বাধ্য করলো। কিন্তু কেন?

ইংল্যান্ডের আলসটার ইউনিভার্সিটির প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এসআর ওসমানীর গবেষণালব্ধ বক্তব্য ‘ উন্নয়ন, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতা’ সম্ভবত বলতে চায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইলে এর নিয়ামকগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা দরকার নইলে শত উন্নয়ন করলেও পেছনের খিড়কি দিয়ে পালাতে হতে পারে। উন্নয়ন ঘটা মানেই স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত নয় বরং স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার থাকলে উন্নয়ন নিশ্চিত স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধরা দেয়।

দুই.
উন্নয়ন, ন্যায়বিচার , এবং স্বাধীনতা বলতে কী বুঝায়? সাধারণ উপলব্ধিতে উন্নয়ন হল নিরেট অর্থনৈতিক ব্যাপার তথা মানুষের বস্তুগত জীবন-মানের উন্নতি। প্রসঙ্গত প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মাঝে পার্থক্যটুকুও জানা দরকার– প্রথমটি নির্দেশ করে নেহাত উৎপাদন বা আয় বৃদ্ধি , দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রবৃদ্ধি প্লাস অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির সাথে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি।

যাই হোক, গেল শতকগুলোতে উন্নয়ন চিন্তকগণ এই ধারণা বিপুল বিবর্তন ঘটিয়েছেন কিন্তু তারপরও অদ্যাবধি তা বিবেচিত হচ্ছে রাজনৈতিক অর্থনীতির অংশ হিসাবেই (পলিটিক্যাল ইকোনমি ) । অপরদিকে, ন্যায়বিচার ন্যস্ত রয়েছে নীতিবিদ্যার অঙ্গ হিসাবে (এথিকস)- পক্ষপাতহীনতা এবং অধিকারবোধ ধারণার খুব কাছাকাছি এর অবস্থান।

খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, ন্যায়ানুগ হওয়া মানে সকলকে সমান চোখে দেখা এবং অন্যদের অধিকারের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা। একটা ন্যায়সঙ্গত সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকের অধিকার, স্বাধীনতা , সম্পদ এবং সুযোগ বিতরণে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। মোট কথা, উন্নয়নের এলাকা হলো রাজনৈতিক অর্থনীতি, ন্যায়বিচার বাস করে নীতিশাস্ত্রে এবং স্বাধীনতার রাজ্য রাজনীতি।

তিন.
তবে লক্ষণীয় যে এই তিনটি দর্শন পৃথক বৈশিষ্ট্যময় হলেও এরা একে অপরের সাথে অত্যন্ত গভীরভাবে গ্রথিত, সম্পৃক্ত এবং সংযুক্ত । বস্তুত বিভিন্ন বিন্দুতে তাদের পথের মিলন ঘটে যার ফলে একটির উপর অন্যটির বা অন্য দুটির প্রভূত প্রভাব প্রতিফলিত হয়। এই আন্তঃসংযোগের পরিণাম হচ্ছে অন্য দুটির সহায়তা ছাড়া যেকোনো একটি লক্ষ্য অর্জন চরমভাবে অপূর্ণ থাকে। কাজেই কোনো একটি লক্ষ্য অর্জনকল্পে একই সাথে তিনটির দিকে তির তাক না করতে পারলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ সরকার সচরাচর যা করে থাকে আমরা যদি সেরকম উন্নয়নকে লক্ষ্যবস্তু করি, তখন আমরা ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার দাবি অবজ্ঞা করতে পারি না। অর্থাৎ, যতক্ষণ না ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, স্বয়ং উন্নয়ন নামক লক্ষ্যটির অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

উৎপাদন তথা জিডিপি বৃদ্ধি করে একটা দেশের জনগণ বা ব্যক্তিখাত; বস্তুত বাজার অর্থনীতিতে উন্নয়নের সব কাজই নাগরিক করে। আসলে সরকার যে উন্নয়নের জয়গান করে সে উন্নয়ন আসে মানুষের শ্রম ও মেধা থেকে। অন্যদিকে, প্রথাগতভাবে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার ভার সরকারের হাতে ন্যস্ত– ব্যক্তিখাতে নয়– কারণ এ সম্পর্কিত সমস্ত প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে সরকার। - আব্দুল বায়েস

প্রসঙ্গত উপর্যুক্ত আলোচনার দুটি ব্যাখ্যান প্রণিধানযোগ্য। প্রথম ব্যাখ্যানের অন্তর্নিহিত যুক্তি হচ্ছে এই যে উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, এবং স্বাধীনতা এই তিনটিই মহামূল্যবান লক্ষ্য। সুতরাং, এদের মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ থাক বা না থাক, অথবা কীভাবে সংযুক্ত সে কথা ভেবে, একটাকে অবজ্ঞা করে অন্য দুটো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সমীচীন নয়। আমরা সবকটি সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি বিধায় নিশ্চয়তা চাই যে তিনটাই পূরণ হোক।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যানে এমনও মনে করা যেতে পারে যে, এদের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধীয় সংযোগ আছে । যেমন আমরা ধরে নেই যে, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা উন্নয়ন গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর তাই ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে উন্নয়ন নিজেই হোঁচট খাবে। প্রথম ব্যাখ্যানটিকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি স্বকীয় ব্যাখ্যা (ইনট্রিনসিক ইন্টারপ্রিটেশন) হিসাবে কারণ কার্যকারণ সম্পর্কের বাইরে এদের প্রত্যেকের স্বকীয় অন্তর্নিহিত গুরুত্ব রয়েছে।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যান হচ্ছে বা কারণীভূত ব্যাখ্যা (ইন্সট্রুম্যানটাল ইন্টারপ্রিটেশন) অর্থাৎ আমরা উন্নয়ন সাধনে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি । অন্য কথায়, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের কারণে উন্নয়ন ঘটছে বলে ধরে নেয়া। আবার কিছু সঙ্গত কারণেই দ্বিতীয়টিতে কংসটিটিউটিভ বা গঠনে সহায়ক এমন ব্যাখ্যান দাঁড় করানো যায়।

চার.
যাই হোক , এই দুই ব্যাখ্যানের তফাত শুধু জ্ঞানজাগতিক বা দার্শনিক নিরিখে নয় বরং অবলম্বিত উন্নয়ন কৌশলের প্রকৃতি বুঝতে পার্থক্যটা খুব ব্যবহারিক তাৎপর্য বহন করে । যদি কেবল প্রথম ব্যাখানে ভর করে কেবলই অন্তর্নিহিত মূল্য- কেন্দ্রিক পথ আলিঙ্গন করা হয়, তা হলে উন্নয়নশীল দেশের কোনো এক সরকার হয়তো উন্নয়নের উপর প্রাথমিক জোর দিয়ে থেমে থাকবে না, চাই কি তাকে নায়ক বানিয়ে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতাকে পার্শ্ব -নায়কের চরিত্রের ভূমিকায় ঠেলে দিতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ তারা যুক্তি দেখাতে পারে যে, তিনটি লক্ষ্য অর্জন সর্বোত্তম কিন্তু বাস্তব জীবনে একই সময়ে একই সাথে তাদেরকে পাওয়া খুব কঠিন; তাই আপাতত দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমরা উন্নয়নকে বেছে নিলাম- ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার দিকটা না হয় পরে দেখবো (যেমন কিছুকাল আগের বাংলাদেশে )। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাখ্যানে এমনটি বলার সুযোগ খুব কম কারণ এই ব্যাখ্যান বলছে , স্বয়ং উন্নয়ন অর্জন করতে হলে আমাদেরকে ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার বিষয়গুলোকে সমান গুরুত্ব সহকারে সামনে আনতে হবে; তাদেরকে ‘পরে’ এমন প্রতীক্ষায় রাখা যাবে না, আমাদেরকে তিন ফ্রন্টে একইসময়ে লড়তে হবে।

যেমন, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে সহায়তা দেয় , উন্নয়নের এমন প্রয়োজনীয় উপকরণ পাশে ঠেলে সরকার বলতে পারে না যে আমরা উন্নয়ন আগে করবো এবং অবকাঠামো নিয়ে ভাববো পরে। তেমনি করেই যুক্তিতে আসবে না উন্নয়ন আগে, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার পরে। বস্তুত ওসমানীর পুরো উপস্থাপনে এই দ্বিতীয় ব্যাখ্যানটিতে ছিল মূল মনোযোগ - অর্থাৎ কারণীভূত বা ইন্সট্রুম্যানটাল ইন্টারপ্রিটেশন।

পাঁচ.
অধ্যাপক ওসমানী অগ্রাধিকার নিয়েও কথা বলেছেন– কী করবো যদি তিনটাই না পারি? এবং আমরা মনে করি আগামী দিনের বাংলাদেশের জন্য এই প্রশ্নের কিংবা উভয়সংকটের সমাধান জরুরি। তাঁর যুক্তিনির্ভর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে এই যে, যদি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা হলে সরকারগুলোর উচিত হবে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতাকে উন্নয়নের উপরে স্থান দেয়া বা বেছে নেয়া।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় বিপরীতটিকে সত্য বলে মেনে নেয়া হয়– উন্নয়ন আগে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা পিছে । বিশেষত উন্নয়নশীল জগতের অধিকাংশ সরকার মোহাবিষ্ট প্রথাগত উন্নয়ন ধারণা নিয়ে। “আমার যুক্তি হচ্ছে তারা যদি প্রকৃতই উন্নয়নকে গুরুত্ব দিতে চায় তা হলে মোহাবিষ্ট হোক ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা নিয়ে ...যদি সরকার ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার দায়িত্ব নেয়, জনগণ দায়িত্ব নেবে উন্নয়নের। একটু ভিন্নভাবে কথাটা এরকম : সরকারকে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বলি, উন্নয়ন নিজেই নিজের খেয়াল করবে।”

মোট কথা, উৎপাদন তথা জিডিপি বৃদ্ধি করে একটা দেশের জনগণ বা ব্যক্তিখাত; বস্তুত বাজার অর্থনীতিতে উন্নয়নের সব কাজই নাগরিক করে। আসলে সরকার যে উন্নয়নের জয়গান করে সে উন্নয়ন আসে মানুষের শ্রম ও মেধা থেকে। অন্যদিকে, প্রথাগতভাবে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার ভার সরকারের হাতে ন্যস্ত– ব্যক্তিখাতে নয়– কারণ এ সম্পর্কিত সমস্ত প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে সরকার।

ছয়.
বাংলাদেশের তেপ্পান্ন বছরের উন্নয়ন বয়ানে প্রথম ব্যাখ্যানটি বহুল স্বীকৃত । অর্থাৎ দেশের উন্নয়ন আসল লক্ষ্য হিসাবে যত প্রচার এবং মনোযোগ পেয়েছে (উন্নয়ন ধাঁধা , রোল মডেল), ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতা কোনো সরকারের আমলেই তেমন গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে হয় না। বিশেষত বিগত পনেরো বছর উন্নয়ন হয়েছে উৎপাদন অর্থে কিন্তু অভিযোগ আছে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা চরমভাবে উপেক্ষিত হওয়ার ।

কেউ ঋণ পেয়ে পাচার করেছে অথচ কারও প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ঋণ পায় নি, ব্যক্তি বঞ্চনার বাইরেও দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি বঞ্চিত হয়েছে; নানা কারণে নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারে না ফলে, ‘অর্ধেক তার করিয়ায়েছে নারী অর্ধেক তার নর’ অবহেলিত থেকেছে। বাক- স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অনুপস্থিতে বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে এবং অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয় এমন তথ্য-উপাত্ত এবং পর্যবেক্ষণের অভাব নেই।

জুলাই–আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তুরুপের তাসের মতো উড়ে গেছে তৎকালীন সরকার, উবে গেছে উন্নয়ন বয়ান। এমনতর উন্নয়ন যেখানে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা সমাধিস্থ , সেই ধরনের উন্নয়ন কাঠের মাচার উপর বহুতল দালান বিশেষ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ ।

কাজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে উন্নয়নের সংজ্ঞা, চালক এবং পথ শনাক্ত করতে হবে বলে আমাদের ধারণা। প্রফেসর ওসমানি সম্ভবত সেদিকে তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত প্রদান করেছেন বলে আমাদের মনে হয়। জনগণকে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিন, বিনিময়ে জনগণ উন্নয়ন উপহার দেবে। বলা যায় সেটাই হবে টেকসই উন্নয়ন, মর্যাদার এবং সমতার উন্নয়ন– বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের দাবি।

“Development consists of the removal of various types of unfreedoms that leave people with little choice and little opportunity of exercising their reasoned agency. The removal of substantial unfreedoms, it is argued here, is constitutive of development.”
― Amartya Sen, Development as Freedom

লেখক : অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট। সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article