পথই যাদের ঘর, তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিন

এ কেমন পৃথিবীতে বেঁচে আছি আমরা? পাবনার ঈশ্বরদীতে আটটি সদ্যোজাত কুকুরছানাকে বস্তাবন্দী করে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার যে ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটেছে, তা কেবল নিষ্ঠুরতাই নয়, বরং আমাদের সমাজের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এক গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হয়েও নিশি রহমান নামক ওই নারী যে বর্বরোচিত কাজটি করেছেন, তা সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। অবলা প্রাণীদের প্রতি এমন আক্রোশ আমাদের মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়। মা কুকুরটি যখন তার সন্তানদের খুঁজছে, ততক্ষণ সেই আটটি ছোট্ট প্রাণ পুকুরের অতলে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে। এই চিত্রটি কল্পনায় আনলেও যে-কোনো সংবেদনশীল মানুষের গা শিউরে ওঠার কথা। অথচ, আমাদের সমাজেই এমন মানুষ বাস করেন যারা নিজেদের \'বিরক্তি\' মেটাতে আটটি প্রাণের স্পন্দন থামিয়ে দিতে দু’বার ভাবেন না। তবে এই অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো হয়ে এসেছে প্রশাসনের তাৎক্ষণিক ও কঠোর পদক্ষেপ। ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আকলিমা খাতুন বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ৪২৯ ধারায় যে মামলাটি করেছেন এবং পুলিশ প্রশাসন যেভাবে দ্রুততম সময়ে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশং

পথই যাদের ঘর, তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিন

এ কেমন পৃথিবীতে বেঁচে আছি আমরা? পাবনার ঈশ্বরদীতে আটটি সদ্যোজাত কুকুরছানাকে বস্তাবন্দী করে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার যে ঘটনাটি সম্প্রতি ঘটেছে, তা কেবল নিষ্ঠুরতাই নয়, বরং আমাদের সমাজের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এক গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হয়েও নিশি রহমান নামক ওই নারী যে বর্বরোচিত কাজটি করেছেন, তা সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। অবলা প্রাণীদের প্রতি এমন আক্রোশ আমাদের মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।

মা কুকুরটি যখন তার সন্তানদের খুঁজছে, ততক্ষণ সেই আটটি ছোট্ট প্রাণ পুকুরের অতলে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে। এই চিত্রটি কল্পনায় আনলেও যে-কোনো সংবেদনশীল মানুষের গা শিউরে ওঠার কথা। অথচ, আমাদের সমাজেই এমন মানুষ বাস করেন যারা নিজেদের 'বিরক্তি' মেটাতে আটটি প্রাণের স্পন্দন থামিয়ে দিতে দু’বার ভাবেন না।

তবে এই অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো হয়ে এসেছে প্রশাসনের তাৎক্ষণিক ও কঠোর পদক্ষেপ। ঈশ্বরদী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আকলিমা খাতুন বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ৪২৯ ধারায় যে মামলাটি করেছেন এবং পুলিশ প্রশাসন যেভাবে দ্রুততম সময়ে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

সাধারণত আমাদের দেশে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বা হত্যার ঘটনাগুলো অনেক সময় এড়িয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু এবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তারের সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং প্রশাসনের তৎপরতা প্রমাণ করেছে যে, আইনের চোখে অপরাধী কেবলই অপরাধী–তার সামাজিক অবস্থান বা পরিচয় যা-ই হোক না কেন। অভিযুক্ত নারী একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাকে গ্রেপ্তার করা আইনের সুশাসনের একটি বড় দৃষ্টান্ত।

এই ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক শক্তি। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর ফেসবুকে যে তীব্র প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় ওঠে, তা প্রশাসনের ওপর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি চাপ সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা বুঝতে শিখেছে যে, পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার অধিকার কেবল মানুষের একার নয়। প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি এই সহমর্মিতা একটি আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পূর্বশর্ত।

উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার যথার্থই বলেছেন, "এ ঘটনা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।" বিশ্বমঞ্চে একটি দেশকে কেবল তার জিডিপি বা অবকাঠামো দিয়ে বিচার করা হয় না, বিচার করা হয় দুর্বল ও অবলাদের প্রতি সেই রাষ্ট্রের নাগরিকদের আচরণ দিয়ে।

ঈশ্বরদীর এই ঘটনাটি সমাজের অন্য সবার জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা। যারা মনে করেন পথকুকুর বা বিড়ালকে পিটিয়ে মারা, বিষ দেওয়া বা পানিতে ডুবিয়ে মারা কোনো অপরাধ নয়, তাদের জানতে হবে—দেশে 'প্রাণিকল্যাণ আইন' এবং 'দণ্ডবিধি' উভয়ই সক্রিয়। প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা এখন আর কোনো 'সামান্য ঘটনা' নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

পথের এই নিঃশব্দ বন্ধুদের প্রতি সম্মান জানাই। কুকুরদের বন্ধুসুলভ, লাজুক এবং উপকারী ভূমিকাটিকে স্বীকৃতি দিই এবং তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার পরিবেশ তৈরি করি। মনে রাখবেন, একটি সহানুভূতিশীল সমাজ কেবল মানুষের জন্যই নয়, সকল প্রাণীর জন্যই নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলে। পথকুকুরদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিই। তাদের প্রতি সামান্য দয়া, খাবার এবং সুচিকিৎসা তাদের জীবনকে যেমন সহজ করতে পারে, তেমনি আমাদের সমাজকেও করে তুলতে পারে আরও নিরাপদ ও সহমর্মী।

আমরা চাই, এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত হোক। আটটি প্রাণের হত্যার বিচার কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি আমাদের মানবিক সত্তা পুনরুদ্ধারের লড়াই। মা কুকুরটির হাহাকার হয়তো আমরা শুনতে পাই না, কিন্তু প্রকৃতির আদালতে এই নিষ্ঠুরতার বিচার একদিন হবেই। তার আগেই মানুষের আদালতে এই জঘন্য অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

একটি সমাজের মানবিকতার সত্যিকারের পরীক্ষা হয়–সে কতটা দুর্বলকে রক্ষা করতে পারে, কতটা অসহায়কে আশ্রয় দিতে পারে। তাই যখন একটি কুকুরের আটটি বাচ্চাকে পানিতে চুবিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটে, তখন প্রশ্নটা শুধু প্রাণীর জীবনের নয়, বরং আমাদের মূল্যবোধের গভীর ক্ষয়প্রাপ্ত অবস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে।

প্রাণী হত্যা বিশেষ করে এভাবে ইচ্ছাকৃত, নিষ্ঠুরভাবে শুধু একটি আইনগত অপরাধ নয়; এটি মানসিক অসুস্থতা ও সামাজিক বিকৃতির স্পষ্ট লক্ষণ। একটি নবজাতক প্রাণীর চোখে ভয়ের যে নিষ্পাপ দৃষ্টি থাকে, সেই দৃষ্টিকে নিঃশেষ করে দিতে যে হৃদয় প্রয়োজন, সেই হৃদয়কে সমাজের জন্য বিপজ্জনক বলাই যায়।

আমরা প্রায়ই বলি–মানুষ বড় হয়েছে, দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, সভ্যতা এগোচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সভ্যতার মাপকাঠি কি শুধু অট্টালিকা, সেতু আর অর্থনৈতিক সূচক? নাকি সহানুভূতি, করুণা আর জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা? যে দেশে অসহায় প্রাণীর প্রতি এমন নির্মমতা করা হয়, সে দেশে উন্নয়ন বড় হলেও মানবিকতা ক্ষুদ্র রয়ে যায়।

প্রাণীকল্যাণ আইন থাকা সত্ত্বেও কেন এমন ঘটনা বারবার ঘটে? কারণ আইন প্রয়োগে ঘাটতি, সচেতনতার অভাব, আর সবচেয়ে বড় সমস্যা–‘প্রাণী তো প্রাণী’--এই ভুল মানসিকতা। অথচ গবেষণা বলে, যারা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর, তারা মানুষের প্রতিও একই আচরণ করতে বেশি প্রবণ। অর্থাৎ এটি সামাজিক অপরাধের আগাম সংকেত।

কুকুরের বাচ্চা হয়তো মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে না, কিন্তু তার ভয়, ব্যথা, কাঁপুনি–সবই আছে। আমরা যদি একটি প্রাণীর কান্না শুনতে না পাই, তবে মানুষের কান্নাও একসময় আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য হয়ে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী–নিষ্ঠুরতা কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না, এটি সময়ের সাথে সম্পর্ক, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এখন সময় এসেছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাণীকল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করা, স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করা, আর সমাজকে মানুষের মতো অনুভব করতে শেখানো। কারণ আমরা যদি দুর্বল প্রাণীর জীবন রক্ষা করতে না পারি, তবে নিজেদের মানবিকতা রক্ষা করব কীভাবে?

প্রতিটি জীবই প্রকৃতির সন্তান। আর যে হাত প্রকৃতির সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, সেই হাত দিয়ে কোনো উন্নয়নই স্থায়ী হয় না। এই ঘটনাটি তাই আমাদের বিবেককে কাঁপানোর শেষ সতর্কবার্তা হওয়া উচিত। মানবিকতা–বিলাসিতা নয়, সমাজ টিকিয়ে রাখার শেষ আশ্রয়।

গবেষণায় দেখা যায়, যে ব্যক্তি অসহায় প্রাণীর প্রতি নির্মম ও নৃশংস আচরণ করে, তার মধ্যে সহানুভূতির চরম ঘাটতি, রাগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা বা গভীর মানসিক বিকৃতি থাকতে পারে। একজন মানুষ যখন বুঝে-শুনে বস্তাবন্দি করে আটটি নবজাতক প্রাণীকে হত্যা করে, তখন সে শুধু আইনের দিক থেকে অপরাধী নয়, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকেও অসুস্থতার লক্ষণ প্রদর্শন করে। যারা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর হয়, তারা অনেক সময় মানুষের প্রতিও নিষ্ঠুরতার প্রবণতা দেখায়–এটি মনোবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত বিষয়। একটি মানবিক, সহানুভূতিশীল মানুষ এ ধরনের কাজ করতে পারে না। অতএব, এটা সুস্পষ্ট যে–এই কাজ ‘মানসিক সুস্থতার অভাব’ ও ‘চরম অসহায়তার প্রতি নিষ্ঠুরতা’— দুইয়েরই প্রমাণ। একজন নারী যখন আটটি কুকুরছানাকে বস্তাবন্দি করে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে— তখন প্রশ্নটা শুধু একটি অপরাধের নয়; এটি মানুষের মানসিকতার গভীর অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি।

সুস্থ মানুষ কখনোই অসহায়, নিরীহ, কথা বলতে না পারা প্রাণীর ওপর এমন নিষ্ঠুর হতে পারে না।

এই আচরণ দেখায়–সহানুভূতির মৃত্যু, নৈতিকতার ভাঙন, এবং মানসিক সুস্থতার ভয়াবহ ঘাটতি। এ ধরনের নিষ্ঠুরতা সাধারণ ভুল নয়; এটি সমাজের জন্য বিপদের আগাম সংকেত। কারণ যে হৃদয় শিশুপশুকে হত্যা করতে পারে, মানবিকতার প্রতি সে হৃদয়ে আর কতটুকু জায়গা অবশিষ্ট থাকে?

প্রশ্নটা তাই খুব সরল–এই কাজ কি একজন সুস্থ মানসিকতার মানুষের কাজ? এটি বিকৃতি, প্যাথলজি, আর নিষ্ঠুরতার নগ্ন উপস্থিতি। মানুষের প্রকৃত পরীক্ষা শক্তিদের সাথে নয়; দুর্বলদের প্রতি তার আচরণে। সে পরীক্ষায় এ ঘটনা সম্পূর্ণভাবে আমাদের মানবিকতার ব্যর্থতা দেখিয়ে দেয়।

আমাদের সমাজে পথকুকুরদের নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও, একটি সাম্প্রতিক জরিপের তথ্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছেন, তাদের এলাকার পথকুকুর সাধারণত 'বন্ধুসুলভ'। আরও ১৫ শতাংশ মনে করেন, কুকুরগুলো 'লাজুক' প্রকৃতির। মাত্র ১০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ এদের 'আক্রমণাত্মক' বলে মনে করেন। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, অধিকাংশ মানুষের কাছেই পথকুকুর ভয়ের কারণ নয়, বরং তারা আমাদের সমাজের একটি শান্ত ও সহাবস্থানকারী অংশ।

কুকুরেরা যে কেবল বন্ধুত্বের প্রতীক, তা নয় তারা আমাদের নিরাপত্তা রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, পথকুকুর থাকায় ৯৬ শতাংশ মানুষ তাদের এলাকায় 'খুবই নিরাপদ' অনুভব করেন। ৫২ শতাংশের মতে, এই কুকুরগুলো নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দেয়। রাতে অচেনা আগন্তুক বা সন্দেহজনক গতিবিধি দেখলে তাদের সজাগ দৃষ্টি এবং সতর্ককারী কণ্ঠস্বর স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে এক ধরনের নির্ভরতা জোগায়।

ঐতিহাসিকভাবেই কুকুর মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে তারা শিকার ধরতে, শত্রুকে দূরে সরাতে এবং দুর্গম পথে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। বিবর্তনের ধারায় নেকড়ে থেকে এই প্রাণীটির জন্ম হলেও, নির্দিষ্ট কিছু জিনগত পরিবর্তন তাদের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ আচরণকে আরও দৃঢ় করেছে। এই বন্ধুত্ব কোনো পোষা প্রাণীর বাধ্যতা নয়, বরং এটি একটি সহমর্মিতার বন্ধন, যা মানুষের আদিম সভ্যতার সময় থেকে শুরু হয়েছে।

এতকিছুর পরও, সমাজে কুকুরের প্রতি নিষ্ঠুরতার ঘটনাও কম নয়। সদ্যোজাত কুকুরছানাদের নির্মমভাবে হত্যা করার মতো ঘটনা আমাদের মানবিকতার মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সৌভাগ্যবশত, এই ধরনের অমানবিকতা রোধে দেশে 'প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯' এর মতো আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইন নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ এবং প্রাণিকল্যাণ নিশ্চিত করার কথা বলে। তবে, আইনের কার্যকারিতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এখনও সময়ের দাবি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাণী হিসেবে তাদের প্রতি দয়া দেখানো কেবল কোনো ধর্মীয় চর্চার অংশ নয় (যেমন মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও কুকুরের উল্লেখ আছে), বরং এটি একটি উন্নত সমাজের পরিচায়ক। কুকুরেরা যদি রাতের অন্ধকারে একটি নবজাতককে পাহারা দিতে পারে, তবে আমাদেরও উচিত তাদের প্রতি মানবিক ও দায়িত্বশীল হওয়া।

আমরা প্রতিদিন যে পথ ধরে হাঁটি, যে অলিতে-গলিতে আমাদের জীবনযাত্রা আবর্তিত হয়, সেখানে একদল নীরব সঙ্গী সর্বদা উপস্থিত–তারা হলো আমাদের পথকুকুরেরা। তাদের জীবন, আচরণ এবং অস্তিত্ব আমাদের লোকালয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যমে কুকুরদের নিয়ে যে মানবিক ঘটনাগুলো উঠে এসেছে–নবজাতকের রক্ষক হওয়া থেকে শুরু করে পথভোলা মানুষের গাইড হওয়া–তা কেবল হৃদয়স্পর্শী নয়, বরং এটি আমাদের সমাজ এবং মানুষের প্রতি এই প্রাণীদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক উজ্জ্বল দলিল। এই আখ্যানগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের পাশে মানুষের শ্রেষ্ঠ সহচর হিসেবে কুকুরের স্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

দীর্ঘদিন ধরে পথকুকুরদের নিয়ে সমাজ একটি বিতর্ক চলে আসছে। টাকা কি কেবল পথের উপদ্রব, নাকি তারা আমাদের সমাজেরই অংশ? সাম্প্রতিক সমীক্ষা এই বিতর্কে একটি স্পষ্ট দিক তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে জরিপে অংশ নেওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রায় ৭৩.৫% তাদের এলাকার পথপুকুরদের ‘বন্ধুসুলভ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এর সঙ্গে আরো ১৫% মানুষ মনে করেন তারা ‘লাজুক’ প্রকৃতির। অর্থাৎ প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষ তাদের প্রতি কোনো শত্রুতা বা পেতে পোষণ করেন না। ‘আক্রমণাত্মক’ মনোভাব পোষণ করেন মাত্র ১০.৮%।

এই সংখ্যাগুলো নির্দেশ করে যে, কুকুরের প্রতি মানুষের ভয় বা বিরক্তি অনেকাংশেই ভুল ধারণা বা অজ্ঞানতা থেকে জন্ম নেয়। কুকুরের সাধারণত সেখানে আক্রমণাত্মক হয় যেখানে তারা নিজেদের বা তাদের শাসকদের বিপন্ন মনে করে। সামান্য খাবার, জলের ব্যবস্থা এবং তাদের প্রতি অফিসের আচরণ পরিবেশ তৈরি করতে যথেষ্ট। কুকুরেরা যে কেবল বন্ধু বা নীরব সাক্ষী তা নয়, তারা অনেক সময় মানুষের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যেমন সেদিন রাস্তায় ফেলে যাওয়া এক নবজাতকের চারপাশে সারারাত ধরে একদল কুকুরের পাহারা দেওয়ার ঘটনাটি আমাদের স্তম্ভিত করে দেয়। তীব্র শীত বা বিপদের মুখেও তারা মানব শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা মানুষের একচেটিয়া গুণ নয়। এছাড়াও পথ ভুলে যাওয়া মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া বাদুর ঘটনার সময় সাহায্য চাই মানুষকে ডাকা, এমন ঘটনা প্রায়ই বহু দেখা যায়। যে প্রকার ঘ্রাণ শক্তি এবং দ্রুত শিখনের ক্ষমতা তাদের করে তুলেছে নির্ভরযোগ্য সহকারী।

বিপরীতে, শাবকদের নৃশংসভাবে হত্যার পর মা কুকুরের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা আমাদের বিবেকে প্রশ্ন তোলে। মানুষের নিষ্ঠুরতা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন পশুর শোক আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আবেগ ও যন্ত্রণার ভাষা সর্বজনীন। এই প্রাণীগুলির প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় আমাদের দেশে প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯-এর মতো আইনি কাঠামো রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে, কেবল আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সমাজের সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

পথকুকুরদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত ও মানবিক পদ্ধতি হলো কুকুর বন্ধ্যাকরণ (Animal Birth Control - ABC) কর্মসূচি। পাশাপাশি, নিয়মিত টিকাকরণের মাধ্যমে জলাতঙ্কের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আমাদের প্রত্যেকের সামান্য সহযোগিতা সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাদের প্রতি ঢিল ছোঁড়া বা তাড়িয়ে না দিয়ে, একটি পাত্রে জল বা অতিরিক্ত খাবার দেওয়া, অসুস্থ কুকুরকে পশু চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো ছোট কাজগুলিই এই সমাজের চেহারা পাল্টে দিতে পারে।

পথকুকুরেরা আমাদের সমাজের এক চলমান প্রতিচ্ছবি। তাদের প্রতি আমাদের আচরণ, তাদের সুরক্ষা এবং তাদের সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান—এ সবই আমাদের সভ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, "প্রাণী হত্যা করে কেউ আনন্দ পায় না, যারা পায় তারা অমানুষ।"

পথকুকুরেরা আমাদের সমাজের নীরব বন্ধু! সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, নবজাতককে পাহারা দেওয়া বা পথভোলার গাইড হওয়ার মতো মানবিকতা এদের মধ্যে প্রবল। এদের প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ হোক। পথকুকুর নীরব রক্ষক, বন্ধুত্বের প্রতীক। মানবিকতার নতুন মানদণ্ড! নবজাতককে পাহারা বা পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় তারা। ৮৮% মানুষ যেহেতু এদেরকে বন্ধুসুলভ বা লাজুক মনে করেন, সেহেতু নিষ্ঠুরতা বন্ধ হোক, ABC ও টিকাকরণ হোক সমাধান। আমাদের সমাজ এদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোক।

আসুন, মানবিক হই। পথের এই নিঃশব্দ বন্ধুদের প্রতি সম্মান জানাই। কুকুরদের বন্ধুসুলভ, লাজুক এবং উপকারী ভূমিকাটিকে স্বীকৃতি দিই এবং তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার পরিবেশ তৈরি করি। মনে রাখবেন, একটি সহানুভূতিশীল সমাজ কেবল মানুষের জন্যই নয়, সকল প্রাণীর জন্যই নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলে। পথকুকুরদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিই। তাদের প্রতি সামান্য দয়া, খাবার এবং সুচিকিৎসা তাদের জীবনকে যেমন সহজ করতে পারে, তেমনি আমাদের সমাজকেও করে তুলতে পারে আরও নিরাপদ ও সহমর্মী।

আর ঘৃণা নয়, সহমর্মিতার চর্চা করি। ঈশ্বরদীর মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনও না ঘটে।

লেখক : কবি ও  কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow