বর্ষা মৌসুমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে পদ্মা-যমুনা। পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে তৈরি হয়েছে তীব্র স্রোত। এতে ব্যাপক ভাঙনের ফলে তীরবর্তী এলাকার বাড়িঘর, ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা প্রতিদিন নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌরুট পাটুরিয়া ফেরিঘাটও পড়েছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা বিপুল বালু ও পাথরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে নদী প্রবাহ সচল রাখতে তীরে আঘাত হানছে এবং সৃষ্টি করছে তীব্র ভাঙন। পাউবোর মতে, পরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ, বাঁক এলাকায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও নদীর প্রবাহ ঠিক রাখলে এ ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ভাঙনে নিঃস্ব মানুষের দীর্ঘশ্বাস
গত কয়েক বছরে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর, শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেলায় শতশত বিঘা জমি নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। গৃহহারা হয়েছে অসংখ্য পরিবার। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হারিয়ে গেছে ভাঙনের গ্রাসে। দেশের ২১ জেলার প্রবেশদ্বারখ্যাত পাটুরিয়া ঘাটও মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।

হরিরামপুর উপজেলার অন্তত ১৩টি মৌজা ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে। গত দুই মাসে দৌলতপুর উপজেলার চর বাঘুটিয়া এলাকায় অন্তত দুই শতাধিক পরিবার বসতভিটা ও আবাদি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। বাঘুটিয়া ইউনিয়নে একসময়ের ২৫ হাজার মানুষের বসতি ছিল। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫ হাজারে। বাকিরা ভিটেমাটি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। হুমকির মুখে রয়েছে নদীরক্ষা বাঁধসহ শতাধিক সরকারি স্থাপনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, এর পেছনে বড় কারণ পদ্মায় অপরিকল্পিত ড্রেজিং।
বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শফিক মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, যমুনা নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণেই ভাঙন হচ্ছে। আমরা বহুবার মানববন্ধন করলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। চর এলাকার ফসলি জমির পাশেই বালু তোলা হয়। এভাবে চলতে থাকলে চর আর টিকবে না।
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের গঙ্গাধরদী গ্রামের বাসিন্দা শাহীন মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন,
অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে গত দুই বছর ধরে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত দশ বছরে চরবাসী অনেক কিছু হারিয়েছে। এখানে হাসপাতাল নেই, একমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিকটিও নদীতে ভেঙে গেছে। কয়েকটি সরকারি স্কুলও বিলীন হয়েছে।
বিলীন ৪২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে অন্তত ৪২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হরিরামপুর ও দৌলতপুর উপজেলা। বর্তমানে আরও ১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার গোকুল চন্দ্র দেবনাথ জাগো নিউজকে বলেন, যেসব স্কুল সরানো সম্ভব আমরা সরিয়ে নিচ্ছি। তবে নদীভাঙন কবলিত এলাকায় পাঠদান চালিয়ে যাওয়া বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। গৃহহারা পরিবারগুলো অন্যত্র চলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
- আরও পড়ুন
- ফলকে নাম কেন, এটি কি আমার বাপের টাকায় করা
- চুয়াডাঙ্গায় মায়ের মৃত্যুর খবরে প্রাণ গেলো ছেলেরও
- কৃষকের গাভি হত্যার অভিযোগ, মৃত্যুর কারণ জানতে হচ্ছে ময়নাতদন্ত
ফেরিঘাটে ভাঙনের প্রভাব
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) জানিয়েছে, মাঝনদীতে চর জাগায় পদ্মার প্রবাহ এখন পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া তীর ঘেঁষে বইছে। এতে ফেরিঘাট এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী নেপাল দেবনাথ জাগো নিউজকে বলেন, ঘাট সচল রাখতে আমরা জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করেছি। পাশাপাশি বিষয়টি মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) জানিয়েছে, তীব্র স্রোতের কারণে ৪ ও ৫ নম্বর ফেরিঘাট বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে যানবাহন পারাপার ব্যাহত হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসির ভারপ্রাপ্ত উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুস সালাম জাগো নিউজকে বলেন,
নদীর স্রোতের কারণে ছোট ফেরি চলাচল করতে পারছে না। বর্তমানে ৩ ও ৫ নম্বর ফেরিঘাট দিয়ে সীমিত আকারে যানবাহন পারাপার চালু রাখা হয়েছে।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, পদ্মা-যমুনার পানির উৎস পাহাড়ি ঢল। এর সঙ্গে লাখ লাখ টন বালু-পাথর আসে, ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়। তখন নদী প্রবাহ সচল রাখতে তীরে আঘাত করে ভাঙন সৃষ্টি হয়। জেলায় সাতটি বালুমহলের ইজারা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সীমানার মধ্যে বালু উত্তোলন করলে সমস্যা হয় না। তবে অপরিকল্পিত ড্রেজিং ভাঙনের বড় কারণ। পরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ, বাঁক এলাকায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও নদীর প্রবাহ ঠিক রাখলেই ভাঙন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
মো. সজল আলী/এমএন/জিকেএস

2 weeks ago
10









English (US) ·