দেশের অন্যতম ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেএফডি জুট মিলস লিমিটেড আবারও বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি খাতে দেওয়ার দুই বছরের মধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন মিলের ৮০০ শ্রমিক-কর্মচারী। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির কোটি কোটি টাকা মূল্যের সচল মেশিনগুলো উৎপাদন বন্ধ হয়ে অচল হয়ে পড়ার উপক্রম।
জানা যায়, ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এই মিলটি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২০ বছরের জন্য বেসরকারি খাতে লিজ পায় ইউনিটেক্স গ্রুপ। ৪৭ একর আয়তনের এই প্রতিষ্ঠানটি ইউনিটেক্স গ্রুপ লিজ পাওয়ার পর সুতা উৎপাদনের পাশাপাশি কার্পেট, জুট, ব্যাগসহ আরও বিভিন্ন উপকরণ উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছিল। যেখানে উৎপাদন হতো দৈনিক ১৮ থেকে ৩০ টন সুতা। উৎপাদিত সুতা রপ্তানি হতো বিশ্বের ১২টি দেশে। কিন্তু দেশের পটপরিবর্তনের পর বন্যার কারণে পাট সংকট ও ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত অর্থের জোগানের অভাবে মিলটির উৎপাদনে ধস নামে।
এভাবে নানামুখী সংকটে উৎপাদন ২ টনে নেমে আসে। এতে ক্রমাগত ক্ষতির মুখে পড়া মিল কর্তৃপক্ষ সরকারকে মাসে ২২ লাখ টাকা ভাড়া চুক্তি থেকে কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করার আবেদন করে। কিন্তু এতে বিজেএমসি রাজি না হওয়ায় মিলের উৎপাদন বন্ধ করে ব্যবসা ঘুচিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সত্যতা নিশ্চিত করে ইউনিটেক্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সহকারী পরিচালক রায়হান আহমেদ বলেন, আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের থেকে সরাসরি পাট সংগ্রহ করি। কিন্তু বন্যার কারণে কৃষকদের থেকে পাট কেনা যাচ্ছিল না। তার ওপর ব্যাংক থেকে টাকা উঠাতে না পারায় নগদ টাকার অভাবও রয়েছে। তার পরও ক্রমাগত লোকসান দিয়ে হলেও মিলটি দুই শিপটে চালু রাখা হয়েছিল। কিন্তু ক্রমাগত ক্ষতির কবলে পড়ায় এই মিলের ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দিলু আক্তার নামে একজন জানান, এই মিলটি নতুন উদ্যোমে চালু হওয়ার পর বাইরের শ্রমিকদের পাশাপাশি স্থানীয় অনেকের কাজের জোগান দিয়েছে। নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি ওভার টাইম, হাজিরা বোনাসসহ নানা সুবিধা নিয়ে সুন্দরভাবেই সংসার চলছিল। কিন্তু মিলটি বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে বিপদে পড়েছেন।
ইউনিটেক্স গ্রুপের প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০২২ সালে লিজ পাওয়ার পর ইউনিটেক্স গ্রুপ মিলের মেশিনগুলো সংস্কার করে। এরপর বিদেশ থেকে নতুন মেশিন আনার চেষ্টায় ১০ মাস অপেক্ষা করেও এলসি বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে মিলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। প্রচুর র-ম্যাটেরিয়াল পুড়ে যায়। যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চলে যায় আরও ছয় মাস। এর মধ্যে বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ সীতাকুণ্ডের একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া মিল থেকে কিছু বস্তা বানানোর মেশিন আনার পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী আবেদন করে এক বছর অপেক্ষা করেও সেগুলো আর পাওয়া যায়নি।
এদিকে মেশিনগুলো পাওয়ার আশ্বাসে মিলের বাইরে থেকে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। তাদের জন্য ৩০টি পরিবার থাকার উপযোগী কোয়ার্টার নির্মাণ করা হয়। মেরামত করা হয় পরিত্যক্তগুলো। আরও ২৫টি নির্মাণ করার জন্য মালপত্র আনা হয়। মিলে আনা শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন, খাবার, রমজানে ইফতার, ঈদে কাপড়, কোরবানির মাংসসহ নানা সুবিধা দিয়ে মেশিন না পাওয়ায় দুই বছরের বেতন-বোনাস দিয়ে তাদের ফেরত পাঠাতে হয়েছে। অন্যদিকে শুধু সুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বিপাকে পড়তে হয় মিল কর্তৃপক্ষের। পাটের দাম মণপ্রতি ২২০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়ে যায় ৩৬০০ টাকা। পরে মিলে মজুতকৃত পাট দিয়ে ১০ মাস চালানো হয়। এর মধ্যে দেশের এ অবস্থায় চরম বিপাকে পড়তে হয়েছে মিলটিকে।
ফলে শুরু থেকে বিভিন্ন মেশিন ক্রয়, পুরোনো মেশিন সংস্কার, রাস্তাঘাট সংস্কার, শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থা করাসহ প্রায় ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলে মিল কর্তৃপক্ষ। এখন ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা মিলটি টিকিয়ে রাখতে মিলের মাসিক ভাড়ার চুক্তি ২২ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করা হলে উৎপাদনে ফেরার সুযোগ রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।