পর্যটনের বিকাশে দেশীয় চলচ্চিত্রের ভূমিকা

8 hours ago 3

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার

বিশ্বব্যাপী ‘ফিল্ম ট্যুরিজম’ বা ‘চলচ্চিত্র পর্যটন’ বহু আগে থেকেই প্রচলিত। এর জনপ্রিয়তা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়তে শুরু করেছে। চলচ্চিত্র পর্যটন বলতে বোঝায়, যেখানে দর্শনার্থীরা চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন শোতে প্রদর্শিত স্থানগুলো দেখতে ভ্রমণ করেন কিংবা কাঙ্ক্ষিত স্থানে নিজস্ব চলচ্চিত্রের শ্যুটিং অথবা নতুন চলচ্চিত্রের জন্য উপযুক্ত শ্যুটিংয়ের স্থান ব্যবহারের জন্য খুঁজতে ভ্রমণ করাকে বোঝায়। এটি চলচ্চিত্রের প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ ও আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে। স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। গন্তব্যস্থলকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে তোলে।

এ পর্যটনকে ত্বরান্বিত করতে নির্দিষ্ট স্থানগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে দর্শকদের আকৃষ্ট করা হয়। চলচ্চিত্রের দ্বারা আকর্ষিত পর্যটন বর্তমানে পর্যটনের দ্রুততম বর্ধনশীল ক্ষেত্রসমূহের মধ্যে অন্যতম। এটি ৯০-এর দশকে পর্যটনের একটি বিশিষ্ট রূপ হিসেবে আবির্ভুত হলেও ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন প্রথম পর্যটন সংস্থা হিসেবে চলচ্চিত্র পর্যটনকে পুঁজি করে গ্রেট ব্রিটেনের একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। যেখানে সিনেমার স্থান চিহ্নিত করা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক ভ্রমণের উত্থান, বিনোদন শিল্পের দ্রুত প্রবৃদ্ধির কারণে চলচ্চিত্র পর্যটনের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। চলচ্চিত্র দীর্ঘমেয়াদী পর্যটন সম্প্রসারণ ও পর্যটন থেকে দীর্ঘমেয়াদী একটি আয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে। একটি চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনে একটি নির্দিষ্ট এলাকার উপস্থিতি এরই মধ্যে বিদ্যমান স্থানের দর্শনার্থীর সংখ্যার ওপর বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। সেই অঞ্চলে একটি নতুন ধরনের পর্যটন তৈরি করতে পারে। স্থানীয় অর্থনীতিতে একটি চাঙা ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি চলচ্চিত্র গড়ে পর্যটন এবং রাজস্ব আয় প্রায় ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ধারণা করা হয়।

চলচ্চিত্রে বিভিন্ন স্থান প্রদর্শিত হয়ে যখন পরিচিতি বৃদ্ধি পায়; তখন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত নয় এমন এলাকায় মিডিয়া এক্সপোজারের আকারে, দর্শনার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যদিও এই নতুন দর্শনার্থীদের বেশিরভাগই আগে এ অঞ্চলসমূহে কখনও যেতেন না কিংবা যাওয়ার পরিকল্পনাও করতেন না। ট্র্যাভেলস্যাট কম্পিটিটিভ ইনডেক্সের এক সমীক্ষায় এর উদাহরণ হিসেবে একটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, শুধু ২০১৭ সালে একটি টেলিভিশন সিরিজ বা চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে একটি গন্তব্যস্থলে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রায় ৮০ মিলিয়ন পর্যটক। সেখানে নতুনভাবে পর্যটকদের গমন শুরু হয়েছিল ২০১৫ সাল থেকে।

প্রথমত চলচ্চিত্র বা টিভি শোতে প্রদর্শিত সুন্দর স্থানগুলো দর্শকদের মনে ভ্রমণের আগ্রহ তৈরি করে। এতে ভ্রমণপিপাসুরা ধীরে ধীরে তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় সেসব স্থানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করলে একপর্যায়ে স্থানগুলো স্থায়ী পর্যটন এলাকা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি অঞ্চলের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরা গেলে সেটি বিশ্বজুড়ে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরপর একদিকে পর্যটকরা যেমন আকৃষ্ট হন; অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে যারা চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র কিংবা টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন; তারা এসব স্থানগুলোকে শো নির্মাণের জন্য বাছাই করেন। এভাবেই চলচ্চিত্র স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে তুলতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্যের অনন্য স্থান। সবুজের সমারোহ, অসংখ্য নদী, পাহাড়, সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভ বন, প্রাচীন স্থাপত্য ও লোকজ ঐতিহ্য মিলিয়ে এ দেশ পর্যটনের জন্য স্বর্ণখনি। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই অপরিসীম সম্পদকে এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। পৃথিবীর অনেক দেশ প্রাকৃতিক সম্পদ বা শিল্পের তুলনায় পর্যটন শিল্পকে প্রধান আয়ের উৎস হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ কিংবা নেপালের মতো দেশগুলো তাদের অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান দিয়ে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। অথচ বাংলাদেশেও সেই সম্ভাবনা বিদ্যমান। তবে তা কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রচারণা।

আরও পড়ুন
আবার লালকুঠি হবে পর্যটকদের বড় আকর্ষণ
আফ্রিকার মাসাই জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন

আগে উদাহরণ হিসেবে যা উপস্থাপন করা হয়েছে; সেটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের পর্যটনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় ক্ষেত্র হতে পারে। বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য ও লোকজ ঐতিহ্যকে চলচ্চিত্র কিংবা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করা গেলে চীন অথবা তাইওয়ানের মতো পাল্টে যেতে পারে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও পর্যটনের গতিপথ। কল্পনাহীন স্থানও পরিণত হতে পারে পর্যটন স্পটে। চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রে উপস্থাপনের পর কোনো স্থানের প্রতি আগ্রহ কখন পর্যটকদের মধ্যে থিতু হয়ে বসে, সেটি কল্পনারও বাইরে থেকে যায়।

পর্যটন শিল্প কেবল বিদেশি মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রই নয় বরং স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং গ্রামীণ উন্নয়নের অনন্য মাধ্যম। সঠিক বিনিয়োগ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি দেশের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে। যা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়। এ মাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে শক্তিশালী অবস্থানে নেওয়াই এখন সময়ের দাবি। তাই এখানে দেশের পর্যটন বিভাগ এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একটি যৌথ উদ্যোগের ব্যাপার রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং অতিথিপরায়ণ মানুষের দেশ। আমাদের দেশের ভূপ্রকৃতি এমনভাবে বিন্যস্ত যে, এখানে পর্যটনের অসীম সম্ভাবনা বিদ্যমান। সমুদ্র, পাহাড়, নদী, বনভূমি, দ্বীপ, চরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা—সবই এখানে ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশও চাইলে এ খাতকে অর্থনীতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। চলচ্চিত্র পর্যটনের মাধ্যমে একটি দেশের পরিচিতি বিশ্বমঞ্চে বিস্তৃত হয়, যা ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও সহায়ক হয়।

চলচ্চিত্র পর্যটন শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরারও এক অসীম সুযোগ। পর্যটনখাতে মিলিয়ন টাকা ব্যয় করে অনেক সময় যে সুফল পাওয়া যায় না, একটি চলচ্চিত্র অথবা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে এর কয়েকশ গুণ বেশি পাওয়া যেতে পারে কাকতালীয়ভাবে। এ খাতের উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ, স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং পর্যটন সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা জরুরি। পর্যটন উন্নয়ন পরিকল্পনায় চলচ্চিত্রকর্মীদের প্রশিক্ষণ, অংশীদারত্ব এবং উপকার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা পর্যটনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে লাভবান হন।

পর্যটন শিল্পে চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কার্যকর উদ্যোগ নিলেই কেবল এটি সফলতার মুখ দেখবে। উদ্যোগের দীর্ঘসূত্রিতা ও অবহেলার কারণে পর্যটনখাত দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত থেকেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি জাতীয় অর্থনীতির প্রধান আয়ের উৎসে পরিণত হতে পারে। চলচ্চিত্র পর্যটন আমাদের শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ও কর্মসংস্থান করার পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। একবিংশ শতাব্দীতে উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য চলচ্চিত্র পর্যটন হতে পারে সবচেয়ে বড় সম্ভাবনাময় শক্তি।

লেখক: পর্যটন বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article