পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় কি অমুসলিমরাই বেশি বাদ পড়েছেন?

ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন বা এসআইআরের খসড়া তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের একটা বড়ো অংশ অমুসলিম বলে প্রাথমিক বিশ্লেষণের উঠে এসেছে। এই তালিকায় থাকা ভোটারদের বলা হচ্ছে ‘আনম্যাপড’, অর্থাৎ যাদের নিজের অথবা পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ২০০২ সালের সর্বশেষ এসআইআরে পাওয়া যায়নি। গোটা রাজ্যে প্রায় ৫৮ লাখেরও বেশি মানুষকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি – তারা হয় মৃত, নয়তো ঠিকানা বদলেছেন। এর বাইরে আরও প্রায় ৩০ লাখ ‘আনম্যাপড’ ভোটারও রয়েছেন বলে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা আগেই জানিয়েছিলেন। আরও পড়ুন>>পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়লো ৫৮ লাখ নামপশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় বিভ্রাট, মুসলিম নেতার নামে এলো হিন্দু পদবি!পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখন ‘মুসলিমপ্রেমী’, ভোটের আগে সুর বদল ওই আনম্যাপড ভোটারদের তালিকা পুরো এখনো বিশ্লেষণ করা যায়নি। তবে কলকাতা এবং কয়েকটি জেলার খসড়া তালিকা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পাচ্ছেন যে, যাদের নাম বাদ গেছে, তাদের একটা বড় অংশ হিন্দু। কলকাতা শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও হিন্দু পদবিধারীদের নামই বেশ

পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় কি অমুসলিমরাই বেশি বাদ পড়েছেন?

ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন বা এসআইআরের খসড়া তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের একটা বড়ো অংশ অমুসলিম বলে প্রাথমিক বিশ্লেষণের উঠে এসেছে।

এই তালিকায় থাকা ভোটারদের বলা হচ্ছে ‘আনম্যাপড’, অর্থাৎ যাদের নিজের অথবা পরিবারের কোনো সদস্যের নাম ২০০২ সালের সর্বশেষ এসআইআরে পাওয়া যায়নি।

গোটা রাজ্যে প্রায় ৫৮ লাখেরও বেশি মানুষকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি – তারা হয় মৃত, নয়তো ঠিকানা বদলেছেন। এর বাইরে আরও প্রায় ৩০ লাখ ‘আনম্যাপড’ ভোটারও রয়েছেন বলে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা আগেই জানিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন>>
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়লো ৫৮ লাখ নাম
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকায় বিভ্রাট, মুসলিম নেতার নামে এলো হিন্দু পদবি!
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখন ‘মুসলিমপ্রেমী’, ভোটের আগে সুর বদল

ওই আনম্যাপড ভোটারদের তালিকা পুরো এখনো বিশ্লেষণ করা যায়নি। তবে কলকাতা এবং কয়েকটি জেলার খসড়া তালিকা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পাচ্ছেন যে, যাদের নাম বাদ গেছে, তাদের একটা বড় অংশ হিন্দু।

কলকাতা শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও হিন্দু পদবিধারীদের নামই বেশি সংখ্যায় বাদ গেছে বলে গবেষকরা জানাচ্ছেন। তারা আরও বলছেন, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় কলকাতা, হাওড়া, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, আসানসোলের মতো শহরাঞ্চলেই নাম বাদ পড়া ভোটারের সংখ্যা বেশি।

অন্যদিকে সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় মুসলিম ভোটারের সংখ্যা বেশি, সেখানে নাম বাদ যাওয়া ভোটারের সংখ্যা খুবই কম। মতুয়া সংখ্যাধিক্য রয়েছে, এমন বিধানসভা অঞ্চলগুলোতে আবার দেখা যাচ্ছে বড় সংখ্যায় তাদের নাম আনম্যাপড হয়ে আছে।

কিন্তু গবেষকরা এটাও জানাচ্ছেন, এসআইআরের পরবর্তী ধাপে যখন নথি যাচাই করা শুরু হবে, তখন কত সংখ্যক মানুষ আসলে বাদ পড়ছেন, তার দিকে নজর রাখতে হবে।

প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে একাধিক গবেষক বলছেন, বিজেপি যে আখ্যান দিতো যে, বিপুল সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছে এবং অনেকগুলো জেলায় ধর্মভিত্তিক জনবিন্যাস বদলে গেছে- তার সঙ্গে এসআইআরের তথ্য মিলছে না।

কলকাতায় হিন্দুদের নামই বেশি বাদ গেছে

ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করছেন সমাজ গবেষণা সংস্থা সবর ইনস্টিটিউটের দুই গবেষক অসীন চক্রবর্তী ও সৌপ্তিক হালদার।

তারা কলকাতা শহর এবং পার্শ্ববর্তী ২১টি বিধানসভা অঞ্চলের তালিকা খতিয়ে দেখেছেন এরই মধ্যে। তারা দেখছেন, মুসলিম অধ্যুষিত নয়, এমন এলাকাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের নাম আনম্যাপড থেকে গেছে। অর্থাৎ ২০০২ সালের তালিকায় তাদের অথবা পরিবারের কারও নাম ছিল না।

বিধাননগর বিধানসভা আসনে (সল্ট লেক এলাকা) সবচেয়ে বেশি মানুষের নাম বাদ গেছে। মোট ভোটারের ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ নাম খসড়া তালিকায় নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ভবানীপুর বিধানসভা এলাকায় ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ মানুষের নাম বাদ গেছে। সবচেয়ে কম সংখ্যক মানুষের নাম বাদ পড়েছে মহেশতলা বিধানসভা আসনে– মাত্র ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

গবেষকরা বলেছেন, কলকাতার তথ্য বিশ্লেষণ করা তাদের পক্ষে সুবিধাজনক হয়েছে, কারণ এখানকার ভোটার তালিকা ইংরেজিতে করা হয়েছে।

চক্রবর্তীর কথায়, তালিকায় থাকা লাখ লাখ মানুষের পদবি তো আর এক এক করে খতিয়ে দেখা সম্ভব না। তাই আমরা একটা মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার করেছি। কিন্তু সেটা আবার শুধু ইংরেজি অক্ষরই শনাক্ত করতে পারে। আমরা তাই আগে ইংরেজি তালিকায় কলকাতার যা আছে, সেগুলোর বিশ্লেষণ করেছি। পুরো রাজ্যের বিশ্লেষণ করতে তাই সময় লাগছে।

মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের চিত্র কেমন?

সবর ইনস্টিটিউটের এ দুই গবেষক কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে পৃথক বিশ্লেষণ করেছেন। চক্রবর্তী ও হালদার জানান, কলকাতার মুসলিম প্রধান অঞ্চল – যেমন বন্দর, পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার এবং কসবা অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুদের নাম বেশি বাদ পড়েছে, অর্থাৎ আনম্যাপডদের তালিকায় আছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম মেটিয়াবুরুজ আসনটি।

‘মুসলিমপ্রধান মেটিয়াবুরুজ এলাকায় যাদের নাম খসড়া থেকে বাদ গেছে, তার মধ্যে ৫৮ দশমিক ৫২ শতাংশ মানুষ মুসলিম, বাকিরা হিন্দু। আবার কলকাতা বন্দর আসনে যতজনের নাম বাদ গেছে, তার মধ্যে মুসলিম ভোটার ৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ, অমুসলিম ৬১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কসবা বিধানসভা আসনে বাদ পড়া হিন্দু ভোটার ৭৮ দশমিক ১৪ শতাংশ, আর মুসলিম ভোটার হলেন ২১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।’

গবেষক অসীন চক্রবর্তী বলেন, কলকাতা শহরে যাদের নাম আনম্যাপড হয়ে আছে, পদবি ধরে আমরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখছি তাদের একটা বড় সংখ্যা হচ্ছে অবাঙালি-হিন্দু। ধরে নেওয়া যেতে পারে, এরা আসলে অন্য রাজ্য থেকে কলকাতায় কাজ করতে আসা মানুষ – যাদের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় ছিল না।

মুসলিমপ্রধান জেলায় কত নাম বাদ?

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমপ্রধান জেলার মধ্যে পড়ে মুর্শিদাবাদ আর মালদা। দুটিই আবার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলা।

এই জেলা দুটিতে এমনিতেই আনম্যাপড ভোটারের সংখ্যা খুবই কম, অর্থাৎ এখানকার প্রায় সব বাসিন্দারই ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় হয় নিজের নাম ছিল বা পরিবারের কারও নাম ছিল।

সবর ইনস্টিটিউটের সমাজ গবেষক সাবির আহমেদ বলছেন, রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক মুসলিম ভোটার আছে মুর্শিদাবাদের ডোমকল ও মালদার সুজাপুর আসন দুটিতে। সুজাপুরে মাত্র ০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ডোমকলে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের নাম আনম্যাপড থেকে গেছে।

মালদা-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের আরও কয়েকটি বিধানসভা আসনের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ভগবানগোলায় ২ দশমিক ৬ শতাংশ, লালগোলাতে ১ দশমিক ১ শতাংশ, সামশেরগঞ্জে এক শতাংশ, রাণীনগরে ০ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের নাম আনম্যাপড হয়ে আছে।

চক্রবর্তী এবং হালদার বলেন, মালদা-মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম অধ্যুষিত জেলা থেকে যখনই মতুয়া অঞ্চলের দিকে নেমে আসা হচ্ছে – যেমন নদীয়া বা উত্তর ২৪ পরগনা, সেখানে আনম্যাপড ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে।

মতুয়ারা পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ তপশিলি জাতির ভোটার। এদের একটা বড় অংশ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলেন। বহু মতুয়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এসেছেন।

আহমেদের কথায়, বাস্তবে, আনম্যাপড ভোটারদের সর্বাধিক সংখ্যা লক্ষ্য করা গেছে মতুয়া-অধ্যুষিত বলয়ে, কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় নয়। মতুয়া-অধ্যুষিত বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে আনম্যাপড ভোটারদের গড় ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ, যা রাজ্যের গড় ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশের দ্বিগুণেরও বেশি।

তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গাইঘাটায় ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ, বাগদা আসনে ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ, রাণাঘাট উত্তর পূর্ব আসনে ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ ভোটার আনম্যাপড হয়ে আছেন – অর্থাৎ ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে কোনও যোগসূত্র এরা দেখাতে পারেননি।

অর্থনীতিবিদ ও নাগরিকত্বের গবেষক প্রসেনজিৎ বসুর কথায়, মতুয়া অঞ্চলগুলোতে আনম্যাপড ভোটারের সংখ্যা খুব বেশি, এটা ঠিক। কিন্তু যাচাই করার পর্বে এরা কতজন নথি দেখাতে পারবেন, সেটাও দেখতে হবে।

মতুয়া ভোট একসময়ে একচেটিয়া ভাবে পেতো বামফ্রন্ট। কিন্তু তারপর তৃণমূল কংগ্রেস সেই ভোট ব্যাংকের দখল নেয়। আরও পরে তাতে আবার ভাগ বসিয়েছে বিজেপিও। মতুয়া মহাসংঘের আড়াআড়ি দুটি ভাগ হয়ে গেছে – একটির প্রধান হলেন কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী - বিজেপির শান্তনু ঠাকুর, আর অন্য অংশটির নেতৃত্বে আছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মমতা বালা ঠাকুর।

‘লাখ লাখ অনুপ্রবেশ’-এর কথা কি ভিত্তিহীন?

বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছে, বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করেছেন এবং নিজেদের নাম ভোটার তালিকায় তুলে ফেলেছেন।

কয়েক বছর আগে থেকে তার সঙ্গে জুড়েছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ধর্মভিত্তিক জনবিন্যাসও বদলিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করা হতো।

এ সপ্তাহের গোড়ায় ভারতের লোকসভায় এক লিখিত জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৭৫২৮ বার অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়েছে এবং ১৮ হাজার ৮৫১ জনকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১০৪ বার অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়েছে, আটক হয়েছেন ২৫৬৬ জন।

তবে এই সংখ্যাটা অনুপ্রবেশের সময়ে গ্রেফতার হওয়ার। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলে থাকেন, গ্রেফতারি এড়িয়ে আরও বহু মানুষ ভারতে অবৈধভাবে এসে থাকেন।

ভারতের নির্বাচন কমিশন যখন এসআইআরের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন তারা একথাও বলেছিল যে একজনও বিদেশি যাতে ভোটার তালিকায় না থাকেন, সেটা নিশ্চিত করতেই এই প্রক্রিয়া চালানো হবে।

অর্থনীতিবিদ ও কংগ্রেস নেতা প্রসেনজিৎ বসু বলছিলেন, বিজেপি যে আখ্যানটা দেওয়ার চেষ্টা করে যে, কয়েক কোটি বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল যে নেই, সেটা তো এসআইআরেই দেখা গেল। মালদা মুর্শিদাবাদে তো খুব সামান্যই আনম্যাপড দেখা যাচ্ছে - অর্থাৎ তারা ২০০২ সালেও ছিলেন। আবার বিহারে তো কবে নির্বাচন হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত একজন অনুপ্রবেশকারীকে দেখাতে পেরেছে নির্বাচন কমিশন?

সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow