পাঠ্যবইয়ে আ’লীগ ‘সবচেয়ে বড় দল’, বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’

9 hours ago 3

 

# ‘সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ আওয়ামী লীগ
# বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’
# জাতীয় পার্টির ‘তৃতীয় বৃহৎ দলের’ স্বীকৃতি বাদ
# জামায়াত নিয়ে ভর্ৎসনা কমলেও রাখা হয়েছে ‘বিতর্কিত ভূমিকা’
# ওয়ার্কার্স পার্টির নাম বাদ, আছে জাসদ-সিপিবি

পাঠ্যবইয়ে প্রায় দেড় দশক ধরে ছিল শুধুই আওয়ামী লীগের গুণগান। বইয়ের পাতায় পাতায় স্থান পায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা গল্প-প্রবন্ধ ও ছবি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পাঠ্যবই থেকে দলীয় গুণগান বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে এবার পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ে আ’লীগ ‘সবচেয়ে বড় দল’, বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’

তবে পরিমার্জিত পাঠ্যবইয়েও উপস্থাপন করা হয়েছে আওয়ামী লীগকে দেশের ‘সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ হিসেবে। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’ বলে উল্লেখ রয়েছে। এ নিয়ে সমালোচনা চলছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভেতরে-বাইরে। ক্ষুব্ধ বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরাও।

পুরোনো বইয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য ছিল। তা অবশ্য ছেঁটে ফেলা হয়েছে। তবে সেখানে থাকা ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ বাক্যটি একই রাখা হয়েছে। যা নিয়ে চলছে সমালোচনা।

শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদরা বলছেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। পাঠ্যবইয়ে যে তথ্য থাকে, সেটাই শিক্ষার্থীরা পড়ে এবং ধারণ করে। এটিকেই তারা প্রকৃত সত্য বলে মনে করে। ফলে যে প্রজন্ম এ লেখা পড়ে বড় হচ্ছে, তাদের মস্তিষ্কে বিষয়টি গেঁথে যায়। এজন্য এমন উপস্থাপনা থেকে বিরত থাকা উচিত।

‘সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক’ দল আওয়ামী লীগ
২০১২ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ নামের একটি বিষয় যুক্ত করা হয়। এ বিষয়ের বই প্রথমবার ছাপা হয় ২০১২ সালে। এরপর ২০১৪ সালে প্রথম পরিমার্জন করা সংস্করণ ছাপা হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত নবম-দশমের শিক্ষার্থীরা বইটি পড়ছে। এবার পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ে দ্বিতীয়বার পরিমার্জন করা হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ে আ’লীগ ‘সবচেয়ে বড় দল’, বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’
বাংলদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ অনুচ্ছেদে আওয়ামী লীগকে দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বলা হয়েছে

বইটির সপ্তম অধ্যায় ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনব্যবস্থা’। এ অধ্যায়ে গণতন্ত্র, রাজনৈতিক দল ও নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সেখানে ‘বাংলদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ’ নামে রয়েছে একটি অনুচ্ছেদ। তাতে তুলে ধরা হয়েছে ছয়টি দলের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

প্রথমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।’

সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।’

২০২৩ সালের পুরোনো বইয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য ছিল। তা অবশ্য ছেঁটে ফেলা হয়েছে। তবে সেখানে থাকা ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ বাক্যটি একই রাখা হয়েছে। যা নিয়ে চলছে সমালোচনা।

বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’
আওয়ামী লীগের পরই পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে বিএনপি। দলটি সম্পর্কে শুরুতে লেখা হয়েছে, ‘সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়।’

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়েও বিএনপি সম্পর্কে একই তথ্য ছিল। তবে পুরোনো বইয়ে থাকা একটি অংশ এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। তা হলো-‘বিভিন্ন দল ও আদর্শের নেতাকর্মীদের একত্রিত করে গঠিত।’ নতুন পাঠ্যবইয়ে বিএনপির পরিচয় দিতে গিয়ে উল্লেখিত অংশটুকু বাদ দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

পাঠ্যবইয়ে আ’লীগ ‘সবচেয়ে বড় দল’, বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’
পাঠ্যবইয়ে বিএনপির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে

যদিও বিএনপির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দলটির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮-এ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি আদর্শ যা জাতি, লিঙ্গ বা বর্ণ নির্বিশেষে সব স্তরের বাংলাদেশিদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়।’

পাঠ্যবইয়ে রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিতে আওয়ামী লীগ নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছিল। সেটা কাটিয়ে উঠে এবার কিছু পরিমার্জন হয়েছে। তারপরও ওমুক দল বড়, ওমুক দল ছোট- এভাবে বর্ণনা করাটা অমূলক।
............. বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম

বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে দায়িত্ব পালন করছেন। জাগো নিউজকে অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ে রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিতে আওয়ামী লীগ নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছিল। সেটা কাটিয়ে উঠে এবার কিছু পরিমার্জন হয়েছে। তারপরও ওমুক দল বড়, ওমুক দল ছোট- এভাবে বর্ণনা করাটা অমূলক।’

তিনি বলেন, ‘যারা বইগুলো পরিমার্জনের কাজ করেছেন, তারা এটা ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে গেছেন, নাকি ভুল করেছেন; তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশের মানুষ, জনগণের চিন্তার বাইরে গিয়ে কোনো দলকে বড় দেখানোটা গ্রহণযোগ্য হবে না। দ্রুত এ বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সংশোধনী দেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে আরও সতর্কতার সঙ্গে বইগুলো দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।’

জাতীয় পার্টির ‘তৃতীয় বৃহৎ দলের’ স্বীকৃতি বাদ
নবম-দশমের পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের পুরোনো সংস্করণে জাতীয় পার্টিকে দেশের তৃতীয় বৃহৎ দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে এবার সেই ‘তকমা’ বাদ দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামের আগে ‘সামরিক শাসক’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ে আ’লীগ ‘সবচেয়ে বড় দল’, বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নামের আগে সামরিক শাসক শব্দ যুক্ত হয়েছে

পুরোনো বইয়ে উল্লেখ ছিল, ‘জাতীয় পার্টি দেশের তৃতীয় বৃহৎ দল। ১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়।’ এবার পরিমার্জিত নতুন পাঠ্যবইয়ে জাতীয় পার্টির পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘১৯৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি সামরিক শাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়।’

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ভর্ৎসনা ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে দলটির অবস্থান, নিষিদ্ধ হওয়া এবং দলের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। নতুন পাঠ্যবইয়ে তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

জামায়াত নিয়ে ভর্ৎসনা কমলেও রাখা হয়েছে ‘বিতর্কিত ভূমিকা’
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাপা বইয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে ভর্ৎসনা ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে দলটির অবস্থান, নিষিদ্ধ হওয়া এবং দলের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। নতুন পাঠ্যবইয়ে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ‘বিতর্কিত ভূমিকা’র কথা এক লাইনে তুলে ধরা হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ে এবার জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘জামায়াতে ইসলামী একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতে মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে এ দলের প্রতিষ্ঠা। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলাম হিন্দ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর নাম হয় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দলটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে কাজ করেছে।’

পাঠ্যবইয়ে আ’লীগ ‘সবচেয়ে বড় দল’, বিএনপির জন্ম ‘সামরিক শাসনামলে’
পাঠ্যবইয়ে একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার কথা এক লাইনে তুলে ধরা হয়েছে

এ বিষয়ে কথা হয় জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইনের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পাঠ্যবইকে তাদের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়েছিল। সেখানে নিজেদের ইচ্ছামতো ইতিহাস জুড়ে দিয়েছিল। জামায়াত সম্পর্কে নানান রকম কুৎসামূলক লেখা ছিল। সেটা বাদ দেওয়া হলেও জামায়াত সম্পর্কে নেতিবাচক কথা এখনো পাঠ্যবইয়ে রয়ে গেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। সব দলকে শিক্ষার্থীদের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরা উচিত।’

ওয়ার্কার্স পার্টির নাম বাদ, আছে জাসদ-সিপিবি
আওয়ামী লীগের আমলে পৌরনীতি বইয়ের এ অধ্যায়ে ৭টি রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও বর্ণনা স্থান পেয়েছিল। এবার নতুন পাঠ্যবইয়ে জায়গা পেয়েছে ৬টি দল। বাদ পড়েছে রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। তবে হাসানুল হক ইনুর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নাম-পরিচয় রাখা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রতিষ্ঠা, ইতিহাস।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দ্রুত কাজ করতে গিয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যেতে পারে। বিষয়টি আমরা আবারও রিভিউ করে দেখবো। আলোচনা করে প্রয়োজনে সংশোধনী দেবো।’

এএএইচ/কেএসআর/জেআইএম

Read Entire Article