পাথর লুট : পরকালে দেওয়া হবে যে ভয়াবহ শাস্তি

1 week ago 14

পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলধারা, তার মাঝেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় সাদা পাথর—সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র একসময় এমনই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের ঠিকানা ছিল। এই এলাকার পাথরের ওপর বসে স্রষ্টার সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতেন পর্যটকরা। তবে সেই সৌন্দর্য এখন কেবলই স্মৃতি। গত চার মাসে ‘প্রকাশ্য দিবালোকে লুট হয়ে গেছে’ কেন্দ্রটির শত শত কোটি টাকার পাথর।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সবার চোখের সামনে চলা এই লুটপাট ঠেকাতে প্রশাসন উদ্যোগ নিলেও তা ছিল দুর্বল ও অকার্যকর। ফলে পর্যটনকেন্দ্রটি হারিয়েছে তার মূল আকর্ষণ।

সাদা পাথর এলাকা থেকে লুট হওয়া পাথরগুলো রাষ্ট্র মালিকানাধীন সম্পদ। আর  রাষ্ট্রীয় সম্পদে পুরো জাতির মালিকানা রয়েছে। তাই তা সংরক্ষণ করা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমনই জনগণেরও। কাজেই রাষ্ট্রীয় যে কোনো সম্পদে রাষ্ট্রের যথাযথ নিয়ম না মেনে হস্তক্ষেপ (লুটপাট) করা কবিরা গোনাহ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। 

এ বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি জানিয়েছেন খ্যাতিমান চার মুফতি। তাদের আলোচনা তুলে ধরেছেন আবু তালহা রায়হান


হাশরের ময়দানে লুটপাটকারীদের অবস্থা ভয়াবহ হবে 

সম্প্রতি সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ও জাফলং থেকে বৈধভাবে লিজ না নিয়েই রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। এতে দেশ ও জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এমন আত্মসাৎকারীর পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। যে যা আত্মসাৎ করবে, তা-ই নিয়ে কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের ভয়াবহতা সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর কোনো নবীর জন্য উচিত নয় যে, (তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের) খিয়ানত করবেন। আর যে খিয়ানত করবে, কিয়ামতের দিনে সেই খেয়ানত করা জিনিসগুলো নিয়েই সে উপস্থিত হবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুরোপুরি দেওয়া হবে যা সে উপার্জন করেছে এবং তাদেরকে জুলম করা হবে না। (সুরা আলে ইমরান : ১৬১)


হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একদিন নবী (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়ান এবং গনিমত বা রাষ্ট্রীয় মাল আত্মসাৎ প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। আর তিনি তা মারাত্মক অপরাধ ও তার ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করেন। নবীজি (সা.) বলেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন এ অবস্থায় কিয়ামতের দিন না পাই, তার কাঁধে বকরি বয়ে বেড়াচ্ছে আর তা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে চিৎকার দিচ্ছে। অথবা তার কাঁধে রয়েছে ঘোড়া আর তা হি হি করে আওয়াজ দিচ্ছে। ওই ব্যক্তি আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো (দুনিয়ায়) তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ তার কাঁধে বয়ে বেড়াবে উট যা চিৎকার করছে, সে আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসুল! একটু সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ তার কাঁধে বয়ে বেড়াবে ধন-দৌলত এবং আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না। আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। অথবা কেউ তার কাঁধে বয়ে বেড়াবে কাপড়ের টুকরাসমূহ যা দুলতে থাকবে। সে আমাকে বলবে, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে সাহায্য করুন। আমি বলব, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারব না, আমি তো তোমার নিকট পৌঁছে দিয়েছি। (বোখারি : ৩০৭৩)

রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটকারী ব্যক্তির শাস্তি : অপরাধের ভয়াবহতা বিবেচনা করে রাষ্ট্র চাইলে যে কোনো শাস্তি দিতে পারবে। চাইলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড বা যেকোনো সময়ের জন্য কারাদণ্ড দিতে পারবে। এ ছাড়া যে কোনো পরিমাণ অর্থদণ্ডও দিতে পারবে।

মুফতি হেলাল আসহাব কাসেমি
প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আব্বাসিয়া কৌড়িয়া, বিশ্বনাথ সিলেট

 


লুটপাট ইসলামে জঘন্যতম অপরাধ

পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা ইসলামে জঘন্যতম অপরাধ। এ ফাসাদ সৃষ্টির মধ্যে লুটপাট, ডাকাতি ও সন্ত্রাস অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ কোরআনে বলেন, আর তোমরা নিজেদের মধ্যে তোমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না এবং তা বিচারকদেরকে (ঘুষ হিসেবে) প্রদান করো না। যাতে মানুষের সম্পদের কোন অংশ পাপের মাধ্যমে জেনে বুঝে খেয়ে ফেলতে পার। (সুরা বাকারাহ : ১৮৮)

নবীজিও (সা.) লুটপাট, অন্যায়ভাবে মানুষের ধনসম্পদ দখল করার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এক বিঘত জমি অন্যায়ভাবে দখল করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সাত স্তর জমি তার গলায় বেঁধে দেবেন। (বোখারি : ২৪৫৩, মুসলিম : ১৬১০)

উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে বোঝা যায়, লুটপাট ইসলামে মারাত্মক গোনাহ, যার শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ। সম্প্রতি সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে অবৈধভাবে তুলে নেওয়া পাথরও মূলত জনগণের সম্পদ। ইসলামের বিধান অনুযায়ী যেখানেই এসব পাথর নেওয়া হয়ে থাকুক, তা ফিরিয়ে দিয়ে স্থানীয় জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। কারণ আমানতের খিয়ানত ও সম্পদ লুট ইসলাম কখনো মেনে নেয় না।

মুফতি আব্দুল্লাহ তামিম
সহকারী মুফতি, মারকাযুশ শায়েখ আরশাদ আল মাদানি, মানিকনগর, ঢাকা


পাথর লুটপাট কেয়ামতের আলামত

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে তেল, গ্যাস,মাটি,  বালু, পাথরসহ নানা ধরণের সম্পদ দান করেছেন। এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত, যা জনগণের সম্মিলিত মালিকানা। ইসলামে এ ধরণের সম্পদ আত্মসাৎ বা লুট করা শুধু হারাম নয়, বরং বড় ধরনের খিয়ানত ও ফিতনা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন, আমানতগুলো তাদের প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দিতে। (সুরা আন-নিসা : ৫৮)

এই আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে মুফাসসিরিনে কেরাম বলেন, জাতীয় খনিজ সম্পদ একপ্রকার জনগণের সম্মিলিত আমানত। তা আত্মসাৎ করা এই আয়াতের সরাসরি লঙ্ঘন।

এদিকে নবীজি (সা.) বলেছেন, যখন আমানতের প্রতি খিয়ানত করা হবে, তখন কিয়ামতের প্রতীক্ষা কর। (বোখারি : ৬৪৯৬)

উল্লিখিত হাদিস থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের দেশের জাতীয় খনিজ  সম্পদ লুটপাট করা মানে বড় ধরনের আমানত খিয়ানত করা। আর এই খেয়ানতই কেয়ামতের আলামাত। 

মুফতি মুস্তাফা আদিল সালিম 
মুহাদ্দিস, শাহপরাণ ধনকান্দী মাদ্রাসা, সিলেট 


রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট কবিরা গোনাহ

ইসলাম রাষ্ট্রীয় বা জনসম্পদকে সবার যৌথ মালিকানা হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই ব্যক্তিগতভাবে এসব সম্পদ ভোগ করা, লুট করা বা আত্মসাৎ করা শুধু রাষ্ট্রীয় অপরাধই নয়, বরং আল্লাহর দৃষ্টিতে এক ভয়াবহ কবিরা গোনাহ। আর মানুষের জাহান্নামে যাওয়ার জন্য একটি কবিরা গোনাহই যথেষ্ট। বিশেষত বান্দার হক নষ্ট করা ইসলামে এমন একটি অপরাধ যা আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না ভুক্তভোগী ক্ষমা করে। তাই রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করলে ক্ষমা পাওয়া খুবই কঠিন, কারণ সবার কাছে  ক্ষমা চাওয়া অসম্ভব। 

এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, কোনো লুটতরাজকারী মুমিন অবস্থায় এরূপ লুটতরাজ করে না যে, যখন সে লুটতরাজ করে তখন তার প্রতি লোকজন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে। (বোখারি : ২৪৭৫)

মুফতি নোমান আহমদ জালালাবাদি 
সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়াতুল কোরআন ওয়াসসুন্নাহ, ইটখোলা, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

Read Entire Article