পাশের বাড়ির মেয়ে তাসনিয়া ফারিণ

4 months ago 28

দেশ ছেড়েছিলাম ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। এর আগ পর্যন্ত ঢালিউড, টালিউড, বলিউড থেকে শুরু করে হলিউডের প্রায় সব খবরই রাখতাম এবং মুক্তিপ্রাপ্ত নাটক, ছবিগুলো দেখতাম। আমি বরাবরই এনিমেশন ছবির ভক্ত তাই বাদ পড়তো না জাপানিজ এনিমেশনগুলোও। এমনকি আমার একটা বন্ধুমহল আছে যাদের বয়স আমার চেয়ে অনেক কম। সহজ করে বললে ওরা সবাই জেন-জি’র সদস্য। ওরা কীভাবে কীভাবে যেন বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সব ছবি নামিয়ে ফেলে। আমি সপ্তাহান্তে ওদের সাথে সাক্ষাৎ করে আমার ভ্রাম্যমাণ হার্ডডিস্কে সেগুলো নিয়ে নিতাম।

আর প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি আর আমার তিন বছরের মেয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে সেগুলো দেখতাম। কিন্তু যখন সপরিবারে প্রবাসী হয়ে গেলাম তখন ওদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে আমাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে শুরু করলাম। ফলে মাথা থেকে নাটক, ছবি দেখার ভুত নেমে গেলো। একটু আধটু উড়ো উড়ো খবর শুনতাম যে, দেশের এই শিল্পমাধ্যমটা একেবারে গোল্লায় গেছে।

সময়ের সাথে একটা সময় জীবনেও স্থিতাবস্থা আসলো। তখন আবার সেই নাটক, ছবি দেখার ভুত মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। নেটফ্লিক্স নামের এপের মাধ্যমে ছবিগুলো দেখা হচ্ছিল। আর নাটকের জন্য এখনও নির্ভর করি ইউটিউবের ওপরে। আমি যেকোনো নাটক বা ছবি দেখার আগে বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সন থেকে সেগুলোর রিভিউ পড়ি। একদিন পত্রিকার পাতায় ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ ছবিটার রিভিউ পড়ে খুবই ভালো লেগে গেলো কিন্তু আমার চরকি এপের সাবস্ক্রিপশন না থাকাতে দেখতে পারছিলাম না। হঠাৎ একদিন একটা ইউটিউব চ্যানেলে সেটাকে পেয়ে অফিসের কাজ ফাঁকি দিয়ে দুপুরের খাবারের বিরতিতে সেটা দেখে ফেললাম। সেই প্রথম তাসনিয়া ফারিনের কোনো কাজ দেখলাম। উনার অভিনয় এতই ভালো লেগে গেল যে এরপর ইউটিউবে খুঁজে খুঁজে উনার অভিনীত নাটক দেখা শুরু করলাম।

প্রবাস জীবনেও আমাদের বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ বাংলাদেশের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি। আমি এখনও অবসর পেলেই ইউটিউবে খুঁজে ইত্যাদির পুরোনো পর্বগুলো দেখি। আর ঈদের ইত্যাদি ছাড়া প্রবাসের ঈদ যেন পূর্ণতা পায় না। বাংলাদেশে যখন সেটার প্রচার শুরু হয় তখন অস্ট্রেলিয়ায় গভীর রাত। তবুও আমি জেগে থাকি এটা দেখার জন্য। তেমনই গত রোজার ঈদের ইত্যাদি দেখতে যেয়ে তাসনিয়া ফারিনের দ্বৈত সংগীত শুনলাম আমার আরেক প্রিয় শিল্পী তাহসানের সাথে।

গানটা এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের বাসায় বেজে চলেছে। তাহসানকে আমি সংগীত শিল্পী হিসেবেই চিনতাম। সে অভিনীত যে প্রথম নাটক দেখেছিলাম সেটা ছিল অফবিট। অনেকদিন নাটক থেকে দূরে থাকায় জানতাম না যে এখনকার প্রজন্মের কাছে তাহসান গায়কের চেয়ে অভিনেতা হিসেবেই বেশি পরিচিত। এরপর আবারো ইউটিউবে খুঁজে দুজনের বেশকিছু নাটক দেখে ফেললাম। তন্মধ্যে ‘কমলা রঙয়ের রৌদ’, ‘মেড ফর ইচ আদার’ খুবই ভালো লাগলো। নিজের গিন্নী ডাক্তার হওয়াতে ‘কমলা রঙয়ের রৌদ’ নাটকে তাসনিয়া ফারিনের অভিনয় যেন বেশিই ভালো লাগলো।

এরপর দেখলাম ‘কারাগার’ ওয়েব সিরিজটা। সেখানে আবিষ্কার করলাম অন্য এক তাসনিয়া ফারিণকে। অভিব্যক্তি দিয়ে চরিত্রের সাথে নিজেকে এতটাই মানিয়ে নিয়েছিলেন যে মনেই হতো না যে অভিনয় করছেন। এরপর একদিন খবর পড়লাম তার নতুন নাটক আনারকলিতে নাচে গানে দর্শকককে মাতাতে আসছেন। সেই নাটকের গান ‘লোকাল বয়’ দেখা হল বহুবার। তারপর দেখলাম নাটকটা। যাত্রাপালা একসময় গ্রাম বাংলার মানুষের অন্যতম বিনোদনের বিষয় ছিল।

এই নাটকে তার অভিনয় দেখে মুগ্ধতা যেন আরও বেড়ে গেলো। এরপর অভিনেতা তাওসিফের সাথে অভিনীত আরও দেখা হলো স্মৃতিস্মারক, রূপকথা নয়, চাওয়া থেকে পাওয়া, মন দুয়ারে, বাটপার কোম্পানি। রূপকথা নয় এবং চাওয়া থেকে পাওয়া নাটক দুটোতে ফারিনের অভিনয় খুবই ভালো লাগলো বিশেষকরে দ্বিতীয় নাটকটা দেখে আবেগাক্রান্ত হয়ে গেলাম যেন।

এভাবে ফারিণের নাটক দেখতে দেখতে নতুন প্রজন্মের আরও অনেক অভিনেতার সাথে পরিচয় হলো। জোভানকে দেখেছিলাম শিশুশিল্পী হিসাবে। সেই জোভান এখন নাটকের পরিচিত নায়ক। জোভানের সাথে ফারিণের অভিনয় আমার খুবই ভালো লাগলো। এরপর ইউটিউব খুঁজে এই জুটির নাটক দেখা শুরু করলাম। রোমিও জুলিয়েট, লাভ এক্সপ্রেস, লাভ ইউ হেট ইউ, লাভ নট রিভেঞ্জ, ফেক প্রেম, ক্লাসমেট, জানেমান তুই আমার, তোমার পিছু ছাড়বো না, উলটা ফুলটা, টুইন ট্রাবল, সুইচ, আমি গাঁধা বলছি এমন আরও অনেক নাটক দেখে ফেললাম।

আমাদের বাসায় আমি রেগে গেলে বাচ্চা দুটোকে গাঁধার বাচ্চা বলে বকা দেয় তাই ওরা আমি গাধা বলছি নাটক দেখে খুবই আনন্দ পেল। আর টুইন ট্রাবল নাটক দেখে বুঝলাম যে ফারিন প্রেমিকার চরিত্রে যতটা চমৎকার অভিনয় করেন ঠিক ততটাই বোনের চরিত্রেও শক্তিশালী। আর সুইচ নাটকে মেয়ের শরীরে আশ্রয় নেয়া ছেলের চরিত্রটা ছিল এক কথায় দুর্দান্ত।

এরপর খবর পড়লাম ফারিণ অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ফাতিমা’ মুক্তি পাচ্ছে। এটা জানার সাথে সাথে যারা অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা চলচ্চিত্র প্রচার করেন তাদের ক্ষুদেবার্তা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ছবিটা আনবেন কি না। তারা এখনও জানান নাই আনবেন কি না। গত সপ্তাহে আমার বোনের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। তখন আপু বলল, ইয়াকুব ফাতিমা ছবিটা আসলে আমাকে খবর দিস। তখন বুঝলাম আমার মত উনিও ফারিণের অভিনয়ের ভক্ত।

মাস খানেক আগে মুক্তি পেয়েছে তরুণ প্রজন্মের আরেক অভিনয় শিল্পী খায়রুল বাসারের সাথে অভিনীত নাটক পরস্পর। এটাতে আরেক ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় খুবই ভালো লেগেছে। আমার মনে আছে আমি ফারিণ অভিনীত প্রথম নাটক এক্স বয়ফ্রেন্ড দেখেছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল নতুন এক অভিনেত্রী আসছেন রাজত্ব করতে। সেটা এখন সর্বজনবিদিত। অভিনয়, নাচে, গানে ফারিন এখন শোবিজ জগতের সবচেয়ে আলোচিত নাম।

ফারিণের অভিনয় ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে। যে চরিত্রই করুক না কেন অত্যন্ত দরদ দিয়ে অভিনয় করেন তাই দর্শক দ্রুতই তাকে গ্রহণ করেন। সামান্য সাত বছরের অভিনয় জীবনে এত বেশি নাটকে এবং চরিত্রে অভিনয় করেছেন যে এখন তাসনিয়া ফারিণ বাংলা নাটকের সমার্থক নাম। তার অভিনয় দেখলে চরিত্রের সাথে সাথে ফারিণকেও খুবই পরিচিত, খুবই আপনার কেউ বলে মনেহয়।

আমি নিশ্চিৎ বেশিরভাগ দর্শকের মতামতও একই রকম। তার একটা নাটকের নাম ‘পাশের বাসার মেয়ে’। সেটা দেখার আগে থেকেই আমি উনাকে পাশের বাড়ির মেয়ে বলে অভিহিত করেছিলাম যে পাড়ার সবারই পরিচিত মুখ। পাশের বাড়ির মেয়ে তাসনিয়া ফারিণের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। তার অভিনয় প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়। পরিশেষে তার কাছ থেকে আরও অনেক চমৎকার কাজ পাবার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

এমআরএম/এমএস

Read Entire Article