পিটার বাটলারের ইগো, সাবিনাদের জিদ

3 hours ago 4

২২ দিন পর জাতীয় নারী ফুটবল দলের যাওয়ার কথা সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে ২৬ ফেব্রুয়ারি ফিফা প্রীতি ও ২ মার্চ একটি আন অফিসিয়াল ম্যাচ খেলার কথা রয়েছে বাংলাদেশের। নারী ফুটবল নিয়ে চলমান সংকটের মধ্যে এই সফরের ভবিষ্যত কি? এমন প্রশ্নে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষারের জবাব ছিল, ‘আরব আমিরাত সফর হবে। দল একটা যাবেই।’

মানে শেষ পর্যন্ত যদি সিনিয়র ফুটবলাররা তাদের আলটিমেটামে অনড় থাকেন, তাহলে বাকিদের নিয়ে দল করে এই সফর চালিয়ে যাবে বাফুফে। আবার যদি উল্টো কিছু হয়, মানে কোচই থাকলেন না; তাহলে অন্য কেউ পুরো শক্তির দল নিয়েই যাবেন বছরের প্রথম এই সফরে। সময় না বাড়ালে বৃহস্পতিবার পাওয়া যাবে বাফুফে গঠিত ‘বিশেষ কমিটি’র প্রতিবেদন। ওই দিনই পরিষ্কার হয়ে যাবে, কী ঘটতে যাচ্ছে এই সফরের ভাগ্যে।

কোচ পিটার বাটলারকে নিয়ে কী অভিযোগ সাবিনাদের, তা লিখিতভাবেই গণমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছেন তারা। তিন পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ১৮ ফুটবলার তাদের সব ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন এই ইংলিশ কোচের বিরুদ্ধে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালীন কোচ বাটলার মেয়েদের অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও এবার দায়িত্ব নিতে এসে বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ার পর নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রেখেছেন। তিনি এমন ভাব করছেন যেন, কিছু হয়নি। যারা অনুশীলনে যোগ দিয়েছেন তাদের নিয়ে নির্ধারিত শিডিউল অনুসারে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন সিনিয়ররা না থাকলেও সমস্যা নেই, তার কাছে যথেষ্ট বিকল্প আছে।

যে ১৮ ফুটবলার সে দিন রাতে বাফুফে ভবনের নিচে দাঁড়িয়ে একযোগে অবসরের হুমকি দিয়েছেন তাদের সবার বিকল্প কি আদৌ আছে পিটার বাটলালের হাতে? বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষক রুপনা চাকমা, সেরা খেলোয়াড় ঋতুপর্ণা চাকমা, মনিকা চাকমারা এখন ফর্মের চূড়ায়। দুইবার বাংলাদেশকে সাফ চ্যাম্পিয়ন করা ফুটবলারদের অন্যতম তারা। বয়সের কারণে সাবিনা, কৃষ্ণা, সানজিদা, মাসুরাকে হয়তো আপনি আলাদা করে রাখলেন, বাকিদের বিকল্প কি আছে বাটলারের? তর্কের খাতিরে তিনি হয়তো বলবেন, ‘আছে।’ বাস্তবে নেই।

সেদিন নারী ফুটবলাররা বলছিলেন, পিটার বাটলারের মধ্যে ইগো ভরা। পিটারের যদি ইগো থাকে, তাহলে সাবিনাদের আছে জিদ। এই দুইয়ের চাপে এখন চিড়েচ্যাপ্টা দেশের নারী ফুটবল। বাফুফে পারছে না ঠিকমতো এসব ঝামেলা সামাল দিতে। এখন একটা বিশেষ কমিটি গঠন করলেও এটি করা উচিত ছিল সাফ চ্যাম্পিয়শিপের পরই।

তখন হয়তো দ্বিতীয়বার শিরোপা উদযাপনের ‘মধুচন্দ্রিমা’ সময়ের মধ্যে ছিলেন বাফুফে কর্মকর্তারা। তবে পিটারকে দ্বিতীয়বার নারী ফুটবলের প্রধান কোচের দায়িত্ব দেওয়ার আগে অবশ্যই এই বিষয়টি ফয়সালা করা উচিত ছিল। কারণ, পিটার বাটলারকে নিয়ে সাবিনাদের অস্বস্তির বিষয়টি হঠাৎ করেই হয়নি। শুরু তো সেই অক্টোববের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে।

সিনিয়র ফুটবলাররা এখন যে বিদ্রোহে করে বসেছেন, সেখানে নেই তাদের বেতন-ভাতার বিষয়। নেই নতুন চুক্তির বিষয়ও। ক্যাম্পে কী খাচ্ছেন, তা নিয়েও তাদের অভিযোগ এখানে নেই। সিনিয়র ফুটবলারদের মুখে ‘এক দফা এক দাবি, পিটার তুই কবে যাবি।’

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমে বলতে গিয়ে অধিনায়ক সাবিনা খাতুন কেঁদেছেন। কেঁদেছেন মাসুরা, মারিয়ারা। সাবিনা খাতুনতো বলেই দিয়েছেন এটা তাদের কাছে এখন ‘আত্মসম্মানের’ ব্যাপার। তাদের নিজেদের প্রমাণের কিছু নেই।

কী আত্মসম্মান? মেয়েদের বেশি কষ্টের জায়গা দ্বিতীয়বার বাটলারকে নিয়োগ দেওয়ার আগে তাদের মনের কথা বাফুফে বুঝতেই চাইলো না। উল্টো বাফুফে কর্মকর্তারা মেয়েদের হুমকি দিয়েছেন। সংকটের গভীরে যাওয়ার আগেই তারা বলে দিয়েছেন, এটা শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। অবশ্যই শৃঙ্খলা ভঙ্গ। কোচের ডাকে মিটিং বা অনুশীলনে না গেলে তো সেটা শৃঙ্খলাভঙ্গই। তবে কোচের কি কোনো দায় নেই?

পেশাদার ফুটবল খেলা এবং কয়েকটি দেশের জাতীয় দলের ডাগআউট সামলানো কোচ পিটার তো মেয়েদের বিষয়টি ফয়সালাই করতে পারেননি। নেপাল থেকে ঢাকায় ফেরার পর মেয়েদের সাথে সংবর্ধনায় ঘুরে বেরিয়েছেন। তবে তিনি কাঠমান্ডুতে তৈরি হওয়া দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নেননি বলেই মেয়েদের অভিযোগ।

সাবিনাদের দাবি, কোচ মিটিং করবেন এমন অপেক্ষায় তারা ছিলেন। কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় ফেরার পরও কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় কোচের বিষয়ে সরাসারি বিদ্রোহমূলক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মিডিয়ায়। ছুটিতে ইংল্যান্ড গিয়েও নিশ্চয়ই পিটার সব জানতে পেরেছেন, মেয়েরা তার বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি নতুন করে সেই মেয়েদের দায়িত্ব নিতে চুক্তি করলেন সাড়ে ২৩ মাসের। মেয়েদের সাথে তৈরি দূরত্ব মিটমাট না করে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব নিয়ে পেশাদারিত্বের তকমা লাগানো যাবে, তবে শিষ্যদের মনের ভেতরে তিনি ঢুকতে পারেননি সেটা পরিষ্কার।

সাবিনারা জিদ ধরে আছেন। এক কথা, ‘পিটার বাদে যে কেউ কোচ হলেই তারা অনুশীলনে ফিরবেন।’ সাবিনা খাতুন এটাও বলেছেন, ‘যে কেউ ডাগআউটে দাঁড়ালেই তারা রেজাল্ট এনে দেবেন।’ এটা কোনো পেশাদারিত্বের কথা নয়। এই কথার মধ্যে এক ধরনের জিদ ও গরিমা প্রকাশ পেলেও বাস্তবতার লেশমাত্র নেই। যদি আমি, তুমি সে-এমন যে কেউ ডাগআউটে দাঁড়িয়ে রেজাল্ট এনে দিতে পারতেন, তাহলে বিশ্বের কোচরা এতদিনে অন্য পেশায় চলে যেতেন।

বাফুফের এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা।’ মতিঝিলের ওই ভবনে এখন দুই রকম সুর। চলছে দোষারোপের প্রতিযোগিতা। যে যার সুবিধা মতো এই সমস্যা তৈরির পেছনে ইশারা-ঈঙ্গিতে তার প্রতিপক্ষের দিকে তির ছুটাচ্ছেন। বাফুফের নতুন কমিটির একপ্রকার লেজেগোবরে অবস্থা।

যদিও তারা অসময়ে একটি কমিটি গঠন করছে ঘটনা খতিয়ে দেখতে। ততদিনে সাফল্যের খবরের পাতা উল্টিয়ে বাংলাদেশের নারী ফুটবল হয়ে গেছে নেতিবাচক খবরের শিরোনাম এবং সেটা দেশে তো বটেই-এমন কি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও।

যে মেয়েদের দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বানাতে বাফুফের রয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রম ও ব্যাপক বিনিয়েযোগ সেই মেয়েদের সংকটে সেই বাফুফেই দিয়েছে অদক্ষতার পরিচয়। বাফুফে ভবনে কান পাতলে শোনা যায় কেউ বলছেন, ‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।’ কেউ বলছেন, ‘এই কোচকে আবার নিয়োাগ দেওয়া ছিল ভুল সিদ্ধান্ত।’

সবার এটা বুঝতে হবে, নারী ফুটবলাররা দুইবার সাফ জিতেছেন। মানে বাংলাদেশকে দুইবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বানিয়েছেন। আপনি চাইলেই একদিনে সাবিনা, কৃষ্ণা, সানজিদা, মনিকা বা ঋতুপর্ণা তৈরি করতে পারবে না। শ্রম আর অর্থ ঢালতে হবে যুগযুগ। তবে একজন পিটার বাটলার পেতে একদিনও সময় লাগবে না। দিন শেষে এই সাবিনারাই আমাদের, পিটার বাটলার নন।

আরআই/এমএমআর/জেআইএম

Read Entire Article