প্রকল্প প্রণয়ন, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ে মোট ২৫টি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পিডি (প্রকল্প পরিচালক) পুল গঠন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করাসসহ বিভিন্ন সুপারিশও উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) সরকারের এক উচ্চপর্যায়ের সেমিনারে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ ও সুপারিশগুলো উঠে আসে। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আয়োজনে ‘হাই-লেভেল ডেসিমিনেশন ওয়ার্কশপ অন কনটেম্পোরারি ইস্যু ইন প্রজেক্ট প্ল্যানিং অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন ইন বাংলাদেশ: এ পলিসি মেকিং পার্সপেক্টিভ’ শীর্ষক এ সেমিনার হয়। সেমিনারে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন। এতে প্রায় সব উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। সেমিনার সকাল ১০টায় শুরু হয় শেষ হয় দুপুরে। বৈঠক সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
সেমিনারে যৌথভাবে প্রেজেন্টেশন দেয় বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
প্রকল্প পরিকল্পনা, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বড় সমস্যাগুলো শনাক্ত ও বিশ্লেষণ; কেস স্টাডির মাধ্যমে সরকারি খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা খুঁজে বের করা এবং নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সংলাপ তৈরি করে সংস্কার ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের পথ খুঁজতে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয় বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের চাপ ও অদক্ষতা। এছাড়া প্রকল্প অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রতা ও বাস্তবায়নে ধীরগতিও রয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই প্রকল্পগুলো বাতিল করা হয়েছে। আগের নিয়োগ পাওয়া প্রকল্প পরিচালকদেরও বদলি করা হয়েছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিপুল সংখ্যক বঞ্চিত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অনেকেই একসঙ্গে দুই-তিন স্তরে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন। এসব কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। এই প্রেক্ষাপটে মূলত সরকার সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তা সমাধানের উপায় খুঁজতে এই উচ্চ পর্যায়ের সেমিনারের আয়োজন করেছে।
সেমিনারে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পিডি পুল গঠন, দক্ষ ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে সম্ভাব্যতার সমীক্ষা করা, সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রকল্প গ্রহণ, নিয়মিত এক্সটার্নাল অডিট সম্পন্ন করা, নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের যানবাহন পরিবহন পুলে জমা দেওয়াসহ বিভিন্ন সুপারিশ উঠে এসেছে।
সেমিনার সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের সংখ্যা এক হাজার ৪৫৪টি। এর মধ্যে, ৬৬৮টি প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়েছে, যা মোট প্রকল্পের ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া নিবিড় পরিবীক্ষণ করা হয়েছে ৫৫টির ও প্রভাব মূল্যায়ন হয়েছে ২১টি প্রকল্পের।
সেমিনারের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ বলেন, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নিয়মকানুনগুলো সম্পর্কে সবাইকে জানানো হয়েছে। যার যতটুকু কনফিউশন বা সমস্যা ছিল সেগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টাসহ কর্মশালায় অংশ নেওয়া সবাই তাদের মতামত দিয়েছেন। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা আরও স্মুথ এবং স্মার্ট হোক আমরা সবাই এটা চেয়েছি।
প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে
সেমিনারে প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়, বাস্তবায়ন পর্যায় ও বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়ের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- যথাযথ সম্ভাব্যতার সমীক্ষা না করা ও অংশীদার পরামর্শ না থাকা, ভৌত কাজের যথাযথ আর্কিটেকচারাল ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন না থাকায় বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভ্যারিয়েশনের উদ্ভব হওয়া, প্রকল্পের সঠিক লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন না করা, প্রকল্প প্রাক্কলনে অযৌক্তিক ব্যয় নির্ধারণ, পরিবেশগত বিষয় বিবেচনা না করা, মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ না করা, পরামর্শ প্রতিষ্ঠানের ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীলতা, প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বীকৃত মডেল ব্যবহার না করা, পিইসি বা ডিপিইসির সভায় আইএমইডির প্রতিনিধির মতামত যথাযথভাবে প্রতিফলন না হওয়া।
প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ের সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না করা, একই ব্যক্তির একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব পালন, অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ না করা ও ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি। ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি সার্ভিস সংক্রান্ত সমন্বয়হীনতা, আইএমইডির পরিদর্শন প্রতিবেদনে বর্ণিত সুপারিশ মোতাবেক পদক্ষেপ না নেওয়া, প্রকল্পের ওয়ার্ক প্ল্যান ও প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান যথাযথভাবে প্রণয়ন, সঠিকভাবে অনুসরণ ও মনিটরিং না করা, ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব যথাসময়ে না পাওয়া, আইএমইডির ই-পিএমআইএস সফটওয়্যারে সব তথ্য যথাসময়ে আপলোড না করা, ডিপোজিটরি/ডেলিগেটেড ওয়ার্ক বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও প্রত্যাশী সংস্থার মধ্যে যথাযথ সমন্বয় না থাকা, প্রকল্পের এক্সটার্নাল অডিট নিয়মিত না হওয়া, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সম্মতি পেতে বিলম্ব।
এছাড়াও রয়েছে, প্রকল্পের বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ে যথাসময়ে প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন আইএমইডিতে দাখিল না হওয়া, সমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় সৃষ্ট অবকাঠামো এবং সংগৃহীত যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করা, প্রকল্পে বিশেষ জনবলের সংস্থার না থাকা এবং যথাসময়ে জনবল নিয়োগ না করা, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট সংক্রান্ত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-এর শর্ত প্রতিপালন না করা, প্রকল্প সমাপ্তির পর যানবাহন সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবহন পুলে জমা না দেওয়া।
আইএমইডির সীমাবদ্ধতা
সেমিনারে প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে আইএমইডির সীমাবদ্ধতাগুলোও উঠে আসে। সেমিনারে বলা হয়, প্রকল্পের সংখ্যা ও পরিধিবৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে আইএমইডির জনবল বাড়েনি। পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কারিগরি সক্ষমতারও অভাব রয়েছে। প্রকল্পে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর গুণগতমান নিশ্চিতে আইএমইডির নিজস্ব পরীক্ষাগার নেই।
সমস্যা সমাধানের উপায়
সেমিনারে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সমাধানের উপায় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
প্রকল্প পর্যায়ে সমস্যা সমাধানের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- গাইডলাইন অনুযায়ী দক্ষ ও নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ দিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা, প্রকল্পের অংশীজনদের চিহ্নিত করে আবশ্যক পরামর্শ করা এবং প্রমাণক ডিপিপির সংযোজনীতে থাকা, যথাযথভাবে ডিজাইন সম্পন্ন করা, প্রকল্পের লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক যথাযথভাবে প্রণয়ন ও যৌক্তিক ব্যয় প্রাক্কলন নির্ধারণ করা।
এছাড়াও রয়েছে, ইকোলজি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণ বিষয়ক ড্রয়িং, ডিজাইন করা, সংস্থার সক্ষমতা বিবেচনা করে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট কম্পোনেন্ট রাখা যার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ে, প্রস্তাবিত প্রকল্প দলিলের সংযোজনীতে কী প্রক্রিয়ায় মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তা তুলে ধরা।
আরও পড়ুন
- সরকারি কর্মচারীদের চিকিৎসা, দাফন-অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুদান বাড়ল
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে নতুন সচিব
আরও রয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত পরিপত্র অনুযায়ী প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ, জমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি সার্ভিস স্থানান্তর সংক্রান্ত আলাদা প্রকল্প নেওয়া, ওয়ার্ক প্ল্যান এবং প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান তৈরি করে যথাযথ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং নিশ্চিত করা, মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই প্রস্তাব আইএমইডিতে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা, যথাসময়ে সব তথ্য ই-পিএমআইএস সফটওয়্যারে আপলোড নিশ্চিত করা, নিয়মিত এক্সটার্নাল অডিট সম্পন্ন করা।
প্রকল্প বাস্তবায়নোত্তর পর্যায়ের সমস্যাগুলো সমাধানে- প্রকল্প সমাপ্তির তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের আইএমইডিতে পাঠানো নিশ্চিত করা ছাড়াও বিদ্যমান সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় কেনা যানবাহন পরিবহন পুলে জমা দেওয়া আবশ্যক ইত্যাদি সুপারিশ এসেছে।
প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সচিবরা যেসব পদক্ষেপ নিতে পারেন
প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের করণীয় তুলে ধরেছে আইএমইডি।
সেখানে বলা হয়েছে, প্রকল্প গ্রহণের আগে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে পরিকল্পনা বিভাগের প্রণীত গাইডলাইন মোতাবেক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুতির ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত পরিপত্র অনুযায়ী প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের পাশাপাশি যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পিডি পুল গঠন করা এবং পুলভুক্ত কর্মকর্তাদের ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, প্রকিউরমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এছাড়া, প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ওয়ার্ক প্ল্যান বাস্তবায়নে নিবিড় মনিটরিং নিশ্চিত করা, আইএমইডির ই-পিএমআইএস সফটওয়্যারে সব প্রকল্পের তথ্য হালনাগাদ নিশ্চিত করা, প্রকল্পের পিএসসি ও পিআইসি সভা করা ও সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন মনিটরিং করা, প্রকল্প সমাপ্তির আগেই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টেকসইকরণের জন্য সাংগঠনিক কাঠামো এবং জনবল নিয়োগের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
আরএমএম/এএমএ