নামাজ এমন এক ইবাদত যার মাধ্যমে মানুষ খুব সহজে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। তবে নামাজ শুধু পড়লেই হবে না বরং নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আদায় করতে হবে। বান্দা যদি প্রকৃতভাবে নামাজ আদায় করে তাহলে সেই বান্দার দ্বারা অশ্লীল ও মন্দ কাজ সংঘটিত হতেই পারে না।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা যারিয়াতের ৫৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘ওয়ামা খালাক্বতুল জ্বিন্না ওয়াল ইনশা ইল্লা লি ইনশা’। অর্থাৎ, ‘আমি জ্বিন ও ইনসানকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ সাধারণ হোক বা অসাধারণ হোক সব মানুষকে ইবাদত করতে হবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কুরআনের ভাষায় ‘আশরাফুল মাখলুকাত।’
আল্লাহতায়ালা এই সেরা জীবকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এ পৃথিবীতে যত প্রকার ইবাদত বা উপাসনার পদ্ধতি রয়েছে এর সম্মিলিত ও পরিপূর্ণরূপ হলো নামাজ। নামাজ হলো ইবাদতের ভিত্তি।
কেননা মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নামাজ ধর্মের স্তম্ভ।’ স্তম্ভ বা খুঁটি ছাড়া যেমন অট্টালিকা বা ঘর নির্মিত হতে পারে না তেমনি নামাজ ছাড়া ধর্ম হতে পারে না। সুতরাং আধ্যাত্মিক সফরের দিক থেকে নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম- (হে আল্লাহর রাসুল!) আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় আমল কোনটি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘নামাজ’। (বুখারি ও মুসলিম)
নামাজ সময় মত আদায় করা সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা নিসা ১০২ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় মুমিনদের জন্য নামাজ সময় মত পড়া ফরজ করা হয়েছে’। নামাজের জন্য দিনে পাঁচবার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সময় মত নামাজ পড়া আবশ্যক।
হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে বলেছেন, ‘কুররাতু আয়নি ফিস্সালাতি।’ অর্থাৎ ‘আমার চোখের স্নিগ্ধতা বা প্রশান্তি আমার নামাজের মধ্যে।’ প্রকৃতপক্ষে কোন ব্যক্তি যখন এ রকম মর্যাদা লাভ করে তখন তার সকল প্রকার আনন্দ, তার মনের প্রকৃত প্রশান্তি হয়ে যায় তার নামাজ।
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো দোয়ার এক বিশেষ মাধ্যম। বিশ্ব চরাচর যখন কোলাহল মুক্ত থাকে, বান্দা তখন একান্ত ভাবে খোদার সমীপে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে দোয়ায় রত হয়ে থাকে। বিগলিত চিত্তে তার মনের সব কিছু ব্যক্ত করে এ সময় আল্লাহতায়ালা বান্দার অনেক নিকটে চলে আসেন। দোয়া অনেক শক্তি রাখে। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখায়।
হজরত রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপরিউক্ত বাণীর অর্থও এটাই। সুতরাং মানুষ আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে হতে নফসের উত্তেজনা হতে মুক্তি পেয়ে উচ্চস্তরে পৌঁছে যায়। এ জাগতিক জীবনের সকল পেরেশানি ও অস্থিরতা হতে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো নামাজ। এ প্রসঙ্গে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আস্সালাতু মিরাজুল মুমিনিন।’ অর্থাৎ, নামাজ মুমিনের মিরাজস্বরূপ। নামাজের মাধ্যমে মানুষ ধাপে ধাপে আল্লাহর দিকে এগোতে থাকে। এভাবে এক সময় আল্লাহ দর্শনের সৌভাগ্য লাভ হয়ে যায়।
নামাজ তথা ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে বিরোধাত্মক শক্তি সহায়ক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে মানুষের আধ্যাত্মিক যাত্রাপথে যথেষ্ট অবদান রাখে। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে সুরা আন কাবুতের ৪৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে।’ আসলে মানুষ অশ্লীল ও অবাধ্য হলেই পাপ কাজে সাহসী হয়। নামাজ আধ্যাত্মিক গোসল স্বরূপ। আধ্যাত্মিক যাত্রা পথে নামাজ এক স্নেহময়ী মায়ের মতো, প্রকৃত নামাজ নামাজির আত্মার সব নোংরা ময়লা কালিমা ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়।
হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা ভেবে দেখ, তোমাদের কারো দরজায় যদি একটি নদী প্রবাহিত থাকে এবং সে এতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে তাহলে তার দেহে কি কোন ময়লা থাকবে? সাহাবা (রা.) বললেন, না, তার দেহে কোন ময়লা থাকবে না। তিনি (সা.) বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হলো এর দৃষ্টান্ত। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা পাপ মুছে দেন’ (বুখারি ও মুসলিম)।
অতএব, নামাজ এভাবে মুমিনকে প্রতিনিয়ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে করতে আধ্যাত্মিক মঞ্জিলের প্রতি এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ক্রমাগত সংশোধনের মাধ্যমে তাকে প্রথমে নীতিবান মানুষ এবং পরে আল্লাহতায়ালার মানুষে পরিণত করে।
এ প্রসঙ্গে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে ঐ কথা বলবো না, যা দ্বারা আল্লাহতায়ালা পাপ মিটিয়ে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? সাহাবা (রা.) আরজ করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ! অবশ্যই বলুন।
হজরত রাসুল করিম (সা.) বললেন, শীত ইত্যাদি কঠিন মওসুমের কারণে মন না চাইলেও ভাল করে ওজু করা, দূর থেকে মসজিদে হেঁটে আসা, এক নামাজের পর পরের নামাজের অপেক্ষা করা, এটিও সীমান্তে পাহাড়ার জন্য ক্যাম্প করার মত কাজ। একথা তিনি (সা.) দু’বার বললেন’ (মুসলিম)।
সুতরাং আমরা যখন আমাদের অন্তরে সীমান্ত প্রহরা ক্যাম্প স্থাপন করব তখন শয়তানের আক্রমণ হতে বাঁচতে পারব। নতুবা শয়তান সেতো চ্যালেঞ্জ দিয়েই রেখেছে যে, সে প্রত্যেক পথ দিয়ে আক্রমণ চালাবে।
তাহাজ্জুদ নামাজের বিষয়েও মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গুরুত্বারোপ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত হজরত নবি করিম (সা.) বলেছেন, রাতের অর্ধেক বা দুই তৃতীয়াংশ যখন অতিবাহিত হয়ে যায় তখন আল্লাহতাআলা নিচের আকাশে নেমে আসেন এবং বলেন, কেউ কি আমার কাছে কিছু চায় যে তাকে দেয়া যায়? কেউ কি কোন দোয়া করে যে তার দোয়া কবুল করা হয়? কেউ কি তার পাপের ক্ষমা চায় যেন তাকে ক্ষমা করা হয়? এমন অবস্থা ফজরের পূর্ব পর্যন্ত বিরাজমান থাকে।
এখানে তাহাজ্জুদ নামাজের কথা বলা হয়েছে। তাহাজ্জুদ নামাজ হলো দোয়ার এক বিশেষ মাধ্যম। বিশ্ব চরাচর যখন কোলাহল মুক্ত থাকে, বান্দা তখন একান্ত ভাবে খোদার সমীপে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে দোয়ায় রত হয়ে থাকে। বিগলিত চিত্তে তার মনের সব কিছু ব্যক্ত করে এ সময় আল্লাহতায়ালা বান্দার অনেক নিকটে চলে আসেন। দোয়া অনেক শক্তি রাখে। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখায়।
সত্যি বলতে কি দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার সত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। আল্লাহপাক আমাদেরকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন আমরা যেন তা উপলব্ধি করে ইবাদত বন্দেগিতে রত থাকি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]
এইচআর/এমএস