প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলবে বাড়তি বন্দর মাশুল

2 hours ago 3
  • • প্রতি টিইইউতে স্ট্যাফিং খরচ বেড়েছে ২৭০০ টাকা
  • • এলসিএল এফসিএল কার্গো নিয়ে নতুন জটিলতা

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলবে বাড়তি বন্দর মাশুল। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বর্ধিত মাশুলের কারণে কাঁচামালের আমদানি খরচ বাড়বে। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন দেশের রপ্তানিকারকরা। দাম বাড়বে অনেক খাদ্যপণ্যের। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য শিল্পের ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন মাশুল আরোপ করে রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) গেজেট প্রকাশ করা হয়। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান সই করা এক প্রজ্ঞাপনে এ গেজেট প্রকাশিত হয়। ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে নতুন মাশুল কার্যকর হয়েছে। ঘোষিত গেজেটে বন্দরের ৫৬ সেবায় গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি মাশুল বেড়েছে কনটেইনার পরিবহনে।

বন্দরের ট্যারিফ বাড়ার কারণে একদিকে কাঁচামাল আমদানি, অন্যদিকে তৈরি খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ব্যয় বাড়বে। আমদানিতে সরাসরি দেশীয় আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে রপ্তানিতে বায়ররা শিপমেন্ট ব্যয় বহন করলেও আন্তর্জাতিকভাবে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বো।- হিফস অ্যাগ্রো ফুডস ইন্ডাস্ট্রির স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মো. শোয়াইব হাসান

ঘোষিত গেজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, পণ্যভর্তি প্রতি টিইইউস (২০ ফুট একক) কনটেইনারে বর্তমানে গড়ে মাশুল দিতে হবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা, যা আগে ছিল কনটেইনারপ্রতি ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। এতে নতুন গেজেট অনুযায়ী কনটেইনারপ্রতি গড়ে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা বাড়তি গুনতে হবে বন্দর ব্যবহারকারীদের। তাতে ২০ ফুটের একেকটি কনটেইনারে গড়ে ৩৭ শতাংশ মাশুল বেড়েছে।

বন্দর মাশুল বাড়ায় তৈরি পোশাক, গমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি ঝুঁকিতে পড়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যও। আমদানি-রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা। আমদানিতে খরচ বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে ভোক্তার ওপর। আর রপ্তানিতে প্রতিযোগিতায় টিকতে করতে হবে সংগ্রাম।

চট্টগ্রামের প্রসেস ফুড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিফস অ্যাগ্রো ফুডস ইন্ডাস্ট্রির স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মো. শোয়াইব হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরের ট্যারিফ বাড়ার কারণে একদিকে কাঁচামাল আমদানি, অন্যদিকে তৈরি খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ব্যয় বাড়বে। আমদানিতে সরাসরি দেশীয় আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে রপ্তানিতে বায়ররা শিপমেন্ট ব্যয় বহন করলেও আন্তর্জাতিকভাবে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বো।’

অ্যাগ্রো প্রসেস ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এখন বন্দরের মাশুল বাড়ানোর কারণে আমাদের কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে খাদ্যপণ্য উৎপাদনে।- নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোমিন আলী

তিনি বলেন, ‘কারণ একই মানের পণ্য যে দেশ থেকে কম খরচে আমদানি করতে পারবে, বায়াররা সেদিকে ঝুঁকবে। সেক্ষেত্রে বন্দরের মাশুল বাড়ানোর কারণে আমাদের অ্যাগ্রো প্রসেস খাতের ব্যবসায়ীরা ঝুঁকিতে পড়বেন।’

সৈয়দ মো. শোয়াইব হাসান বলেন, ‘একটি ২০ ফুট কনটেইনারে ১৮ টন পর্যন্ত পণ্য দেওয়া যায়। আগে আমরা দুই টন, চার টন কিংবা ১০ টন পণ্য আনলেও এটিকে এলসিএল হিসেবে গণ্য করা হতো। এখন নতুন ট্যারিফে দুই টনের অধিক হলে তা এফসিএল হিসেবে গণ্য হবে বলে গেজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পণ্যের আমদানি খরচ আরও বেড়ে যাবে।’

বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি এ খাতে নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। কারণ বন্দরের ট্যারিফ বাড়ার কারণে সব ধরনের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে স্বাভাবিকভাবে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। ইউনিটপ্রতি ব্যয় বাড়লে আমরা প্রতিযোগিতা হারাবো।- বাপা সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক

এই রপ্তানিকারক বলেন, ‘আগে ২০ ফুটের একটি কনটেইনার স্ট্যাফিং খরচ ছিল ৭ হাজার ২শ টাকা, নতুন ট্যারিফে বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৯শ টাকা। একইভাবে ৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে স্ট্যাফিং চার্জ ছিল ৯ হাজার ৫শ টাকা। বর্তমানে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪ হাজার ৯শ টাকা। ঘোষিত গেজেটে কার্গো ল্যান্ডিংয়েও টনপ্রতি ৬৩ টাকা চার্জ বাড়ানো হয়েছে।’

বন্দর মাশুল বাড়ার বিষয়ে নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোমিন আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অ্যাগ্রো প্রসেস ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এখন বন্দরের মাশুল বাড়ানোর কারণে আমাদের কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে খাদ্যপণ্য উৎপাদনে।’

প্রসেসড ফুড রপ্তানিতে শীর্ষে থাকা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর কারণে আমাদের আমদানি-রপ্তানি উভয়ের খরচ বেড়ে যাবে। এমনিতে ফ্রেইট চার্জ অত্যধিক। তার ওপর বন্দরের হ্যান্ডলিং চার্জ বেড়ে গেলে কাঁচামালের দাম বাড়বে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে রপ্তানি বাজারে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বো। পাশাপাশি ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের দামে প্রভাব পড়বে।’

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলবে বাড়তি বন্দর মাশুল

কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অ্যাগ্রো প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিটা একটি উদীয়মান খাত। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া গেলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। কৃষিকে আরও লাভজনক করা সম্ভব হবে। এতে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসবে, যা রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তৈরি করা সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, ‘নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অ্যাগ্রো প্রসেস খাত একটু এগিয়ে গেলে সরকারের নীতি সুবিধা না পেয়ে আবার পিছিয়ে পড়তে হয়। বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি এ খাতে নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। কারণ বন্দরের ট্যারিফ বাড়ার কারণে সব ধরনের কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে স্বাভাবিকভাবে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। ইউনিটপ্রতি ব্যয় বাড়লে আমরা প্রতিযোগিতা হারাবো। বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির ব্যয় বেড়ে গেলে বায়াররা বিকল্প খুঁজতে চাইবে। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে আমরা বায়ারদের ধরে রাখতে পারবো না। এতে পুরো শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বাপা সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিশ্বের ১০৬টি দেশে দুই লাখ তিন হাজার ৬৯২ টন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এতে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার ডলারের বেশি।

এমডিআইএইচ/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস

Read Entire Article