সংগ্রামে, দ্রোহে অনুপ্রেরণা জোগানো একটি উক্তি, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’। কথাটা সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উক্তিটি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুনে’র। উপন্যাসের শেষে ছাত্রদের নাম ধরে ধরে জেলখানায় ঢোকানোর সময় ডেপুটি জেলার সাহেব হাঁপিয়ে ওঠেন।
বিরিক্তর সঙ্গে বলেন, ‘উহু, এত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়। জেলখানা তো এমনিতে ভর্তি হয়ে আসছে।’ পাশ থেকে ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলেন, ‘এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব।’
উপন্যাসটা আগেও পড়া ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনে এই উপন্যাসের সংলাপ দেখে আবারও পড়লাম। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের অভিজ্ঞতায় লেখক আরেক ফাল্গুন উপন্যাস রচনা করেন।
এ উপন্যাসটির পটভূমি হলো একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন। ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বৈরাচারী সরকারের সব বাধাকে উপেক্ষা করে শহীদ দিবসকে যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নে মুনিমের মতো আসাদ, সালমা, নীলা, রানু, বেনু, রাহাত, কবি রসুল দিন-রাত কাজ করে যায়। পোস্টার ও লিফলেট ছাপানো, কালো ব্যাজ বিতরণ, স্লোগান ও অন্যান্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সবাই অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত এবং সক্রিয়।
সবাই শপথ করে তিন দিন নগ্ন পায়ে হাঁটবে, শহীদদের স্মরণে রোজা রাখবে, কালো ব্যাজ ধারণ করে ২১ ফেব্রুয়ারির দিন কালো পতাকা উত্তোলন করে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবে। এরপর ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসে তারা গ্রেপ্তার হয়। তাদের অন্তরে ছিল ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মাতৃভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা। মনে ছিল দৃঢ় অঙ্গীকার আর মাথানত না করার প্রত্যয়। লাশের মিছিল দীর্ঘ হলেও তারা মাথানত করে না। দ্রোহের পাশাপাশি উপন্যাসের চরিত্রগুলোর প্রেম, প্রণয়ও উঠে এসেছে।
এরপর থেকেই যেন আমরা বিভিন্ন ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে পথে নেমেছিলাম। সেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দলোন সবখানেই যেন জহির রায়হানের এই উপন্যাসের ছায়া বিদ্যমান। ১৯৫২ সালের হিসেবে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল বাঙালি, যারা মোট নাগরিকের প্রায় চুয়ান্ন শতাংশ। ওই সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। গঠিত হয় সর্বদলীয় একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা ঠিক করেন- তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন।
আজকের ঢাকা মেডিকেল কলেজ সে সময় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। সেখানে ২১শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভকারীরা ১৪৪ ধারা ভাঙতে গেলে পুলিশ ছাত্রদের গ্রেফতার করে, পরে কাঁদানে গ্যাসও নিক্ষেপ করে। দুপুরের পর বিক্ষোভরত ছাত্রদের একটি দল গণপরিষদ ভবনের দিকে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুল জববার, আবুল বরকত নিহত হয়। বহু আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তাদের মধ্যে আবদুস সালাম মারা যায়। অহিউল্লাহ্ নামে আট-নয় বছরের এক কিশোরও সেদিন নিহত হয়।
১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্র হয়। পাকিস্তানি শাসকেরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার আসামিদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মল্লিকসহ চারজন।
নব্বই এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ যখন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সে সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিএনপি মনোনীত ও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেই সামরিক আইন জারি করেন। সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্ররা।
সব কয়টি ছাত্র সংগঠনের মিলিত শক্তির আন্দোলনের কাছে সেনাবাহিনী সমর্থিত জেনারেল এরশাদ টিকতে পারে নাই। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য এর আন্দোলনের সঙ্গে দেশের জনগণ সম্পৃক্ত হলে তা গণ আন্দোলন থেকে গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সেই গণ অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ৪ঠা ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং ৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। দীর্ঘ ৯ বছর পরিচালিত আন্দোলন ১৯৯০ এ এসে গণআন্দোলনের রূপ নেয়। সেই গণআন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগ করেছিল।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই আন্দোলনে নামে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। আন্দোলনে নানান ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে বদল আসে স্লোগানে। এসব স্লোগান আন্দোলনকারীদের মধ্যে বারুদের মতো কাজ করে। জোগায় ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রেরণা। শুরুতে আন্দোলন অহিংসই ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চড়াও হলে ১৫ জুলাই আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। এরপর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন প্রবল আন্দোলনের রূপ নেয়। বাড়তে থাকে সহিংসতা। শেষে সরকার পতনের এক দফা দাবি তুলে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন সফল হয়। ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের।
কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের দাবি ৩৬ দিনের এই আন্দোলনে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন স্লোগান। ১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ স্লোগানটি আন্দোলনে নতুন গতি দিয়েছিল। এরপর একে একে এসেছে অনেক স্লোগান - ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’; ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’; ‘যে হাত গুলি করে, সে হাত ভেঙে দাও’ এবং ‘অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ ইত্যাদি।
আরও অনেক স্লোগান এসেছে যেমন- ‘চাইলাম অধিকার হয়ে, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ এবং ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’। এমনকি শোনা গেছে আঞ্চলিক ভাষার স্লোগান যেমন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার স্লোগান- ‘আঁর ন হাঁইয়্যে, বৌতদিন হাঁইয়্য’ যার অর্থ আর খেয়ো না, অনেক দিন খেয়েছ। বিক্ষোভ থেকে আরও শোনা গেছে, ‘আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে’; ‘আমার ভাই জেলে কেন’ এবং ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’—এসব স্লোগান। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলে, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ স্লোগানটি।
বায়ান্ন সালের ফাল্গুন মাসে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রফিক, বরকত, জব্বার সালাম প্রতিষ্ঠা করেছিল আমাদের ভাষার অধিকার। আর পঞ্চান্ন সালে তাদের সেই ত্যাগকে স্মরণ করতে গিয়ে কারাবরণ করে অনেক ছাত্র জনতা। অনেকে প্রাণও হারান। এরপর ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা পাকিস্তানের দ্বিতীয় জাতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। তাই এখনও যেকোন দাবি আদায়ের প্রশ্ন আসলেই ‘আরেক ফাল্গুন’ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। ঠিক একই কায়দায় এখনকার ছাত্ররা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করলো। কোটা সংস্কার আন্দোলনেও যখন দমন পীড়নে ছাত্ররা যখন দিশেহারা হয়ে উঠেছিল তখনও তাদের সাহস জুগিয়েছিল এই উপন্যাসের শেষ চরণ- ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’।
এমআরএম/এএসএম