প্রতিশোধের আগুনে ভস্মীভূত ৭ বসতঘর

3 months ago 7

ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ দম্পতি রমিজ উদ্দিন হাওলাদার ও বকুল বেগম তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে কাঁদছিলেন। গেলো পাঁচদিন পর সোমবার (২৬ মে) তারা বাড়ি ফিরেছেন। চোখের সামনে তিল তিল করে গড়ে তোলা বাড়িটির এই দশা দেখে তারা নির্বাক। খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোর নেই বাসস্থান কিংবা খাবার। এমনকি গায়ের একটি মাত্র কাপড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তাদের।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার কুচাইপট্টি ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মোতাইতের পরিবারের সঙ্গে একই এলাকার কাশেম আলী খাঁয়ের পরিবারের জমি সংক্রান্ত ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। বুধবার (২১ ওম) দুপুরে সেই বিরোধকে কেন্দ্র করে শেরু মার্কেট এলাকায় কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আবুল কাশেমের ওপর হামলা চালায় কাশেম আলী খাঁয়ের লোকজন। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে তাকে দ্রুত উদ্ধার করে গোসাইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

প্রতিশোধের আগুনে ভস্মীভূত ৭ বসতঘর

আবুল কাশেমের মৃত্যুর খবর চরমাইঝারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে প্রতিপক্ষের লোকজনের অন্তত ৭টি বসতঘরে আগুন দেয়। এছাড়া ছয়টি বসতঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। পরে খবর পেয়ে গোসাইরহাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এই ঘটনার পরদিন ৫২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের বড় ভাই জসিম মোতাইত। মামলায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

সরেজমিনে দেখা যায়, আলাদা আলাদা তিনটি স্থানে দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে অন্তত ৭টি বসতঘর। ঘরে থাকা শস্যদানাসহ সব আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। আগুনে নারিকেল গাছ, কাঁঠাল গাছগুলোও ফলসহ পুড়ে গেছে। সোমবার বিকেল পর্যন্তও দুটি ঘরে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী বকুল বেগম জানান, বুধবার দুপুরে শেরু মার্কেট এলাকায় পূর্ব শত্রুতার জেরে খুন হন স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মোতাইত। যা চর মাইঝারা এলাকা থেকে অন্তত ৪ কিলোমিটার দূরে। হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে অন্তত শতাধিক দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় রমিজ উদ্দিন হাওলাদারসহ অন্তত ১৫টি বসতবাড়িতে। এসময় তাদের বাড়িঘরগুলো থেকে টাকা-পয়সা, মূল্যবান সামগ্রী এবং গরু ছাগল লুট শেষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। যা থেকে অবশিষ্ট কোনো কিছুই বাঁচাতে পারেননি তারা। লুট হয়েছে আটটি গরু ও তিনটি ছাগল।

বকুল বেগমের দাবি, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন তারা। শুধু মাত্র দল করার কারণে প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়তে হয়েছে তাদের। একইসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবুল কাশেম মোতাইতের হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের বিচারের দাবিসহ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

এদিকে লুটপাট থেকে রেহাই পাননি দল না করা ব্যক্তিরাও। এমনটাই দাবি করেন আয়েশা বেগম। তিনি জানান, চার বছর আগে স্বামী আনোয়ার হোসেন শিকদার মারা যান। এরপর থেকে ১১ বছরের মেয়ে শান্তনা ও ৯ বছরের ছেলে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহকে নিয়ে বসবাস করে আসছেন। পরিবারের অভাব অনটন ঘোচাতে লালনপালন করতেন দুইটি গরু ও একটি ছাগল। গত বুধবার লুটপাটের সময়ে তার গরুটি মাঠেই বাঁধা ছিল। খবর পেয়ে তিনি তার গরুটি আনতে গেলে রোষানলে পড়েন লুটপাটকারীদের। একপর্যায়ে তাকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখালে কিছুই করতে পারেননি তিনি। চোখের সামনে থেকে লুট হয়ে যায় তার গরুটি।

প্রতিশোধের আগুনে ভস্মীভূত ৭ বসতঘর

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার একটা গরু আছিলো, সেদিন লুটের সময় সেটাও নিয়া গেছে। আমরাতো কারো দল করি নাই। ছোট দুইডা বাচ্চা লইয়া কোনো মতে বাইচ্চা আছি। আমি আমার মাল ফেরত চাই। আপনারা একটু ব্যবস্থা করে দেন। আমার তো কেউ নাই, চলার মতো পথও নাই।’

এদিকে ঘটনার পর পুরো এলাকা হয়ে পড়েছে পুরুষশূন্য। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করায় জনমনেও রয়েছে আতঙ্ক। শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে পোড়া ঘরবাড়ি আর গাছগাছালি। পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারির পাশাপাশি ঘটনাস্থলে রয়েছে গ্রাম পুলিশও।

এ বিষয়ে জানতে কাশেম হত্যা মামলার বাদী জসিম মোতাইতের মুঠোফোনে কল করলে তিনি বলেন, আমরা কারো বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করিনি। তারা নিজেরাই ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোসাইরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাকসুদ আলম বলেন, হত্যার ঘটনায় এজাহার পাওয়ার পর মামলা দায়ের হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি। এলে আমরা আইনগতভাবে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবো। ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে সেজন্য প্রশাসন তৎপর রয়েছে।

বিধান মজুমদার অনি/এফএ/জিকেএস

Read Entire Article