প্রথম পিরিয়ডেই হারিয়ে গেলো একটি জীবন

2 months ago 8

খালিদ বিন মোজাহিদ

প্রথম পিরিয়ডেই হারিয়ে গেলো একটি জীবন—কে নেবে এই দায়?
কুমারী একটি মেয়ে, বয়স মাত্র তেরো কিংবা চৌদ্দ। জীবনের প্রথম পিরিয়ড শুরু হয়েছিল কিছুদিন আগে। শুরু থেকেই তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছিল ধীরে ধীরে। জ্বর, পেটে ব্যথা, অবিরাম রক্তপাত—সব মিলিয়ে সে প্রায় দশ দিন ধরে বিছানায় পড়ে ছিল। পরিবারের লোকজন প্রথমে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ভাবছিল, ‘মেয়েদের এমন তো হয়ই!’

কিন্তু অবস্থার অবনতি ঘটতেই শুরু হয় দুশ্চিন্তা। একসময় এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়; যখন আর কিছু করার থাকে না। বাধ্য হয়ে মেয়েটিকে বিকেলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক জানালেন—মেয়েটি মারাত্মক রক্তশূন্যতায় ভুগছে। জরুরি ভিত্তিতে রক্ত দরকার, তার ব্লাড গ্রুপ এবি পজিটিভ।

রক্ত জোগাড় করে রাত ১টার দিকে তাকে রক্ত দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। তার শরীর সেই রক্ত নিতে পারেনি। কারণ সেই ছোট্ট মেয়েটি এরই মধ্যে নিঃশব্দে প্রাণ হারিয়েছে—রক্তশূন্যতার কারণে।

ঘটনাটি সুন্দরবনের একেবারে কোলঘেঁষা, প্রত্যন্ত একটি গ্রামের। মেয়েটির বাড়ি থেকে জঙ্গল মাত্র ২০ গজ দূরে, মাঝখানে শুধু একটি নদী। পল্লী বিদ্যুৎ এসেছে মাত্র চার বছর আগে। এখনো নেই পাকা রাস্তা, নেই কোনো আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।

এ অঞ্চলে ‘মাসিক’ শব্দটি এখনো উচ্চারণযোগ্য নয়। এটি যেন এক অপবিত্র, লজ্জাজনক, নিষিদ্ধ কোনো ঘটনা। এখানকার মেয়েরা এখনো পিরিয়ডকালীন স্যানিটারি প্যাডের পরিবর্তে ব্যবহার করে নোংরা, বারবার ব্যবহৃত ন্যাকড়া। স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এতটাই যে, একজন কিশোরী পিরিয়ডের সময় অবিরাম রক্তপাতেও সাহায্য চাইতে পারেনি।

আরও পড়ুন

হয়তো অনেকে বলবেন, পরিবারের দোষ। তারা কেন বুঝলো না? কেন গুরুত্ব দিলো না? তাদেরও যদি জিজ্ঞেস করা হয়, উত্তর আসবে—তারা জানেই না এসব ব্যাপার। এ অঞ্চলে শিক্ষার হার বলতে গেলে ২ শতাংশেরও কম। এখানকার নারীরা আধুনিকতা বা শহরের সুযোগ-সুবিধা দেখেছে কেবল টেলিভিশন বা মোবাইল ফোনের পর্দায়।

আমরা আজ ২০২৫ সালে বাস করছি—যেখানে চাঁদের বুকে ঘর বানানোর স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে, নারীরা মহাকাশে যাচ্ছে, প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে আঙুলের ডগায়। অথচ এমন এক সময়ে, এমন উন্নত বিশ্বের পাশে—একটি কিশোরী মারা যায় শুধু পিরিয়ডের সময় যথাযথ যত্ন না পাওয়ার কারণে।

পিরিয়ড কোনো অভিশাপ নয়। এটি একটি মেয়ের জীবনের এক গৌরবময় সূচনা—নারীত্বের পথে প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু আমাদের সমাজের বহু জায়গায় এখনো এটি লজ্জা, সংকোচ ও অজ্ঞতার কারণে ধামাচাপা পড়ে থাকে।

মেয়েটির মৃত্যু হয়তো ভাগ্য বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় কিন্তু বাস্তবে এটি আমাদের সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থা এবং সচেতনতার মারাত্মক ব্যর্থতা।

যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, যদি মা-বাবারা সন্তানদের প্রাথমিক শারীরিক ও প্রজনন শিক্ষা না দেন, যদি স্কুলগুলোতে যৌন ও স্বাস্থ্য শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেওয়া হয়—তবে এমন মৃত্যু আরও ঘটবে।

এ মৃত্যু কেবল একটি মেয়ের নয়, এটি আমাদের সবার—সমাজের, অবহেলার, অজ্ঞতার।
আজই সময় এসেছে ‘পিরিয়ড’ শব্দটিকে সম্মানিত করার। মেয়েরা প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা সহ্য করে, রক্ত দিয়ে, কষ্টে থেকেও জীবন এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে—এই মৃত্যু যেন আর কোনো মেয়ের জীবনের শেষ অধ্যায় না হয়।

(লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত)

এসইউ/এমএস

Read Entire Article