প্রধান শিক্ষক পদে যুবলীগ নেতা, ফাঁদে পড়ে ইংরেজি শিক্ষক গরুর রাখাল

7 hours ago 3

নাম মো. মতিউর রহমান। ২০০৪ সালে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার পবনতাইড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পর প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয়। এমপিওভুক্ত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতা প্রধান শিক্ষক জোবায়দুর তার ক্ষমতা দেখিয়ে ১৫ জনের অধিক শিক্ষক-কর্মচারীকে বাদ দিয়ে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে নতুন করে নিয়োগ দেন। 

এরই মধ্যে মতিউর রহমানও একজন। তিনি ২০ বছর বিনা বেতনে চাকরি করার পর বয়সের ভারে অন্য কোনো কাজ করতে পারছেন না। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাড়িতে গরু পালন করে সংসার চালাচ্ছেন। যে হাতে থাকার কথা ছিল পাঠ্যপুস্তক সে হাতে এখন তার গো-খাদ্য ও গোবর। সারাদিন গরু লালনপালন করে দিন পার হয় তার।

শুধু মতিউর রহমান নন, তার মতো শাহ আলম, মাহফুজা আক্তার সাথী, আনিছুর রহমান, আব্দুর রশিদ সরকার, আবুল কালাম আজাদ, আনোয়ার হোসেন, আলী আজমসহ কমপক্ষে ১৫ শিক্ষক-কর্মচারী অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন পার করছেন। কেউবা চাকরি খোঁজে গিয়েছেন ঢাকায় বা অন্য জেলায় আবার কেউবা করছেন ব্যবসা। আর কিছু সংখ্যক ভুক্তভোগী শিক্ষক চাকরি ফেরত পেতে ঘুরছেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের বারান্দায়। 

জোবায়দুর রহমান প্রধান শিক্ষক হওয়ার সুবাদে তিনি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার নাম করে এলাকার বহু মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অভিযোগের পাহাড় নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাননি তিনি।

দীর্ঘ দুই মাস অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ৬নং ঘুড়িদহ ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি। এ জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় শক্তি প্রয়োগ করেছেন সব সময়। চাকরি তো দূরের কথা পথের ফকির বানিয়েছেন অনেককে। এমনকি তিনি ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা হওয়ায় ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের প্রয়াত সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও এমপি ফজলে রাব্বির ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে নিয়োগ বাণিজ্য করে অঢেল সম্পত্তির মালিক ও আলিশান রাজকীয় বাড়িও নির্মাণ করেন। এছাড়া নতুন নতুন জায়গা-জমি ক্রয় করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

প্রতিকার চেয়ে একাধিকবার প্রশাসনের উচ্চপদের কর্মকর্তাদের নিকট অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয়নি। উল্টো জোবায়দুরের দাপটের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে ভুক্তভোগীদের।  

ভুক্তভোগী শিক্ষক মতিউর রহমান বলেন, ‘১৫ লাখ টাকা না দিতে পারায় প্রায় ২০ বছর চাকরি করার পর প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক সেই চাকরি থেকে বাদ দেওয়ায় পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। বর্তমানে গরু লালনপালন করে জীবিকা নির্বাহ করি। আমি আমার চাকরি ফেরত চাই।’

এদিকে ভুক্তভোগী ধর্ম শিক্ষক পদে থাকা গোলাম আজম বলেন, ‘আমাকে ধর্ম শিক্ষক বানানোর কথা বলে স্কুল মেরামতের দোহাই দিয়ে দফায়-দফায় মোট প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন। যখন দুই লাখ টাকা দেই আমি দেখেছি তখন সে সাঘাটা বাজারে জমি ক্রয় করে। এমপিওভুক্ত হওয়ার পর নতুন নিয়োগ দিবে তার কাছে টাকা চাইতে গেলে ডেপুটি স্পিকার ও আওয়ামী লীগের প্রভাব দেখাত। ভয়ে সে সময় চুপ ছিলাম। আমি আমার টাকা ফেরত চাই অথবা চাকরি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘সে যুবলীগের ইউনিয়ন সভাপতি হওয়ায় আমাকে জামায়াত-শিবির বলে জেলে ভরাবেন তাছাড়া তার দলের লোকজন দিয়ে হুমকি দিত। ফ্যাসিস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলে গেছেন তবে এসব দোসর রেখে গেছেন এখনো। একাধিকবার শিক্ষা অফিস ও ইউএনওকে লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি তারা। প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাবি দ্রুত এই ফ্যাসিস্ট প্রধান শিক্ষককে বহিষ্কার ও চাকরিচ্যুত এবং আমার মতো সব শিক্ষকের চাকরির ব্যবস্থা করা হোক।’

আরেক ভুক্তভোগী শিক্ষিকা মাহফুজা আক্তার সাথী বলেন, ‘স্কুলের উন্নয়নের কথা বলে ২০১৫ সালে আমার কাছে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে ১৬ লাখ টাকা দাবি করে। তবে তাকে ১৪ লাখ টাকা জমি বিক্রি করে দেই। কিন্তু হঠাৎ শুনি আমার চেয়ে অন্য আরেকজনের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে তাকে চাকরি দেয়। বর্তমানে সে চাকরিও দেয় না, টাকাও ফেরত দেয় না। সরকারের কাছে এরকম প্রতারকের শাস্তি দাবি করছি।’

সাঘাটা বাজারের স্থানীয় মো. আলতাফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে স্কুল বিজনেস করে উনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। উনাকে এর আগে সাথীর ভাই টাকার জন্য সাঘাটা বাজারে আটকেও রাখছিল। টাকা দিতে রাজি হলে ছেড়ে দেয় সবাই। এই প্রধান শিক্ষক শিক্ষক নামের কলঙ্ক।’

মতিউর রহমানের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘প্রথমে সাড়ে তিন লাখ টাকা চাকরির জন্য চায়, তা দিয়ে ২০ বছর চাকরি করার পর এমপিওভুক্ত হলে জোবায়দুর স্যার আবার ১৫ লাখ টাকা চায়। তা না দিতে পারায় প্রধান শিক্ষক জোবায়দুর রহমান আমার স্বামীকে চাকরি থেকে বাদ দেয়। বর্তমানে গরুর খামার চালাচ্ছেন আমার স্বামী। কোনোরকম দিন যাচ্ছে আমাদের। সরকারের কাছে চাই আমার স্বামী যেন চাকরিটা ফেরত দেয়। আর এরকম প্রতারককে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’ 

অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক জোবায়দুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ পুরোপুরি ভুয়া, ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।’

এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আতাউর রহমান কালবেলাকে বলেন, ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নামে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

Read Entire Article