প্রশাসন নীরব, ইসি এলাকায় উঠছে বহুতল ভবন

5 months ago 64

কক্সবাজারে ভবনের পর ভবন নির্মাণ করতে অমান্য করা হচ্ছে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) আইন। কক্সবাজার সৈকত থেকে ওপরে ৩০০ মিটারে নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ মানা হচ্ছে না সেই নিষেধাজ্ঞা। ভবন তৈরিতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক), জেলা প্রশাসন এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের অনুমতির তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা।

সূত্রমতে, পরিবেশগত বিবেচনায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে টেকনাফ সমুদ্রসৈকতের ১০ হাজার ৪৬৫ হেক্টর এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য, নির্মল জলরাশি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় ১৯৯৯ সালে এ এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। এ নির্দেশনা মতে, কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের বদর মোকাম পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্রসৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটার উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা। এ এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ।

লাবণী পয়েন্টে ২০১৭ সালে সার্কিট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ১০ তলা ভবন তৈরির সিদ্ধান্তে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে ছাড়পত্রও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইসিএ-তে এমন কাণ্ড হচ্ছে দেখে সেসময় হাইকোর্টে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে পৌরসভার প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত।

প্রশাসন নীরব, ইসি এলাকায় উঠছে বহুতল ভবন

সূত্র জানায়, ইসিএ হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় আগে বরাদ্দ পেলেও স্থাপনা নির্মাণ না হওয়া অর্ধশতাধিক প্লটের বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেসব বাতিলও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (কউক) সৈকত থেকে ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালায়। বাতিল বলে ঘোষণা করা হয় স্থাপনা নির্মাণে আগের অনুমতিও। এরপর কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্টে কোনো নতুন স্থাপনা না উঠলেও চলতি বছরের শুরু থেকে এসব এলাকার একাধিক প্লটে দেদারসে নির্মাণকাজ চলছে।

প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় মাস দেড়েক ধরে কলাতলীর তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস ও ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের মাঝখানে খালি জমিতে দিনরাত সমান তালে নির্মাণকাজ চালাচ্ছে একদল শ্রমিক। সৈকতের বালিয়াড়ির দেড় থেকে দুইশ ফুট দূরত্বে চারপাশে দেওয়াল তুলে শ্রমিকরা বিরামহীন কাজ করছেন। নিচের বেসমেন্ট পাকাকরণের পর নিচতলা তৈরি করতে পিলার ও ছাদের লোহা বাঁধার কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এ প্লটে ভবন তৈরির কাজ হচ্ছে দেখে একই লাইনের খালি একাধিক প্লটে স্থাপনা নির্মাণ করতে মাটি ভরাটের কাজ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ইসিএ রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

প্রশাসন নীরব, ইসি এলাকায় উঠছে বহুতল ভবন

তবে যে প্লটে নির্মাণকাজ চলছে সেই জমির মালিকের নাম বলতে নারাজ শ্রমিকরা। কাজ তদারক করা প্রকৌশলী নুরুজ্জামান বলেন, কাজের সব কাগজপত্র প্রকল্পের প্রধান তদারককারী প্রকৌশলী মিজানের কাছে। এসব দেখাতে কক্সবাজার শহরের লালদিঘির উত্তর পাড়ে তার (প্রকৌশলী মিজানের) অফিসে নিয়ে যান তিনি। কাজের বিপরীতে যে কাগজ দেখান তা ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসন ও ২০১৬ সালে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীর সইয়ে অনুমোদন পাওয়া প্ল্যান।

নিয়মমতো কাজ শুরু না করায় এবং ২০১৬ সালের শেষের দিকে স্বতন্ত্রভাবে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) কার্যক্রম শুরুর পর আগের অনুমোদনে ভবন তোলা সম্ভব কি না—এমন প্রশ্নে প্রকৌশলী মিজান বলেন, ‘আমরা কউকের অথরাইজ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে কাজ করছি।’

এ বিষয়ে যাত্রা থেকে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা কউকের সাবেক চেয়ারম্যান লে. কর্নেল ফোরকান আহমেদ জানান, কউক স্বতন্ত্র যাত্রা না করা পর্যন্ত জেলা প্রশাসক চেয়ারম্যান ও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তখন পৌর এলাকায় কক্সবাজার পৌরসভা থেকে পাওয়া অনুমতিতে ভবন নির্মাণ হয়েছে। পৌরসভা থেকে অনুমতি নিলেও ২০১৬ সালে কউক স্বতন্ত্র কার্যক্রম শুরুর আগ পর্যন্ত যেসব প্লটে নির্মাণকাজ নির্ধারিত পরিমাণ হয়নি, সরেজমিন তদন্তসাপেক্ষে সেসব প্লটের প্ল্যান বাতিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে নতুন কোনো স্থাপনা করতে গেলে কউক এবং সংশ্লিষ্ট আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমতিপত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক।

তিনি আরও বলেন, সরকার ও উচ্চ আদালত কর্তৃক ঘোষিত ইসিএতে কোনোভাবেই অনুমতি দেওয়ার সুযোগ কউক বা অন্য প্রতিষ্ঠানের নেই। যে প্লটের কথা আসছে তা তখন খালি থাকায় আগের অনুমোদন বাতিল ও নতুন কোনো অনুমতি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

প্লটের দেওয়ালে লেখা রয়েছে ‘জমির মালিক এলিগেন্স ডেভেলপমেন্ট প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলহাজ এমদাদ উল্লাহ’। সেখানে দেওয়া ফোন নম্বরে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথমে অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করছেন বলে দাবি করেন। তবে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের অনুমতি হিসেবে অটো বাতিল এবং সৈকতের বালিয়াড়ি থেকে ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপনা নির্মাণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি শুরুতে কিছু কাজ করেছিলাম। পরে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কাজ বন্ধ ছিল, এখন আবার করা হচ্ছে। আমার জায়গা আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি।

প্রশাসন নীরব, ইসি এলাকায় উঠছে বহুতল ভবন

‘কিন্তু নির্মাণশ্রমিকরা গত একমাস ধরে বেইজ খুঁড়ে নতুন নির্মাণকাজ শুরু করেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন’—এমনটি বলার পর এমদাদ উল্লাহ বলেন, ‘আমরা এরইমধ্যে জেলা প্রশাসক ও কউকের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা হয়েছে। দু-একদিনের ভেতর কাজের পারমিশন ফাইনাল হয়ে যাবে।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘কক্সবাজারে এখন ভবন নির্মাণ করতে হলে কউকের পারমিশন ছাড়া অসম্ভব। আমরা কাউকে বেআইনি সহযোগিতা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ নামের (এমদাদ) কাউকে আমি চিনি না। ইসি এলাকায় ভবন নির্মাণের বিষয়ে কারও সঙ্গে আমার বৈঠক বা কথাও হয়নি।’

ভবন নির্মাণের অভিযোগের বিষয়ে জানতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নুরুল আবছারের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি একবাক্যে রিপ্লে লেখেন, ‘ওকে, আই শ্যাল লুক ইনটু ইট (ঠিক আছে বিষয়টি আমি দেখবো)’।

তবে, কউক সচিব মো. আবুল হাসেম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি চেয়ারম্যান স্যারের নলেজে আছে। তিনি যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সেভাবে এগুলো হবে।’

সায়ীদ আলমগীর/এসআর/জেআইএম

Read Entire Article