প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু ‘হত্যাকাণ্ড’ বিবেচনা করে বিচারের দাবি

3 weeks ago 13

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশু প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড' হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছে সচেতন নাগরিক সমাজ।

বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের আব্দুস সালাম মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের অনুসন্ধানে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে এ দাবি জানান তারা।

উন্নয়ন সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবিরের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফারহা তানজীম তিতিল।

ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, গৃহকর্মীদের সুরক্ষা এবং কল্যাণের জন্য বারবার সরকারের কাছে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি ও অনুরোধ জানানো হলেও বাস্তবে আমরা এর কোনো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। সাম্প্রতিক সময়ে গৃহকর্মীদের নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা আমাদের এর প্রয়োজনীয়তার কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুরে ডেইলি স্টারের সাবেক নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এ শিশুটির অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। এ ঘটনার পর গত ৪ এপ্রিল তিনি চাকরিচ্যুত হন।

তিনি বলেন, প্রীতি উরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ঘিরে তাকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু, স্বাধীন, নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত, পক্ষপাতহীন ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই আমরা। ওই বাসায় আরও কয়েকজন শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

একটি টিভি চ্যানেলে প্রীতিকে পরীক্ষাকারী একজন ডাক্তার বলেছেন, প্রীতির গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পায়ুপথের আকৃতি অস্বাভাবিকভাবে বড়। দুর্গামণি বাউরি নামে ওই বাড়ির আরেকজন শিশু গৃহকর্মী জানিয়েছে, সৈয়দ আশফাকুল হক তাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছে। তার মাথায় রক্ত জমে গিয়েছিল। প্রীতিকে আট তলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী। প্রীতির বাবা অভিযোগ করেছেন, ওই গৃহে কাজ করার সময় সৈয়দ আশফাকুল হকের পরিবার প্রীতিকে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে দিত না। তারা পারিশ্রমিকও পেয়েছেন সামান্য। এসব ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে আমরা সোচ্চার।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যথাযথ তদন্ত হলে অভিযোগের সত্যতা মিলবে। তাই সরকারের কাছে বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার নিরপেক্ষ, দ্রুত, সুষ্ঠু, পক্ষপাতহীন, প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছি।

সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট খুশী কবির বলেন, প্রীতি ওরাং নামে আদিবাসী মেয়েটিকে নিয়ে এসে হত্যা করা হয়েছে। আমি এটিকে হত্যাই বলব। যেভাবেই হোক, সে অ্যাকসিডেন্ট হোক বা নিজ উদ্যোগে হোক, অথবা তাকে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, যে তার জীবন চলে যায়। এটা মানা যায় না। আমরা অবশ্যই এর সুষ্ঠু বিচার, নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। সেই সাথে আমরা সরকারকে স্পষ্টভাবে আমরা বলতে চাই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের একটা মূল্য আছে। একজন অতি শিক্ষিত, দায়িত্ববান ব্যক্তি, তার বাড়িতে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তার মানে প্রত্যেকটা বাড়িতে অহরহ এটা ঘটতে থাকে। আমরা এটা আর সহ্য করবো না।

এ সময় সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো:

১. প্রীতি ওরাংয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু বা হত্যার সুষ্ঠু স্বাধীন নিরপেক্ষ, পক্ষপাতহীন, প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

২. প্রীতি ওরাংয়ের মৃত্যুকে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করা হলে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে হালকা করা হবে। এ মামলা অবিলম্বে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় এনে নারী শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। এর জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কিংবা প্রয়োজনে উচ্চ বিচার বিভাগীয় নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।

৩. প্রীতির পরিবারকে যথোপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। সেইসাথে তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪. আশফাকুল হকের বাসায় নির্যাতিত অন্য যে শিশুটি বেঁচে আছে তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৫. শিশুটির শরীরের বিশেষ ক্ষতটি পরীক্ষা করে প্রকৃত ঘটনার তদন্ত করতে হবে। প্রয়োজনে আইনি প্রক্রিয়ায় দোষীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।

৬. সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ৩ জন শিশু গৃহকর্মী ছিল। তারা ৭, ৮ এবং ১১ বছর বয়সে কাজে যোগ দেয়। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তি শিশু। শ্রম আইনের ৩৪ ধারা অনুযায়ী, কোনো শিশুকে কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যায় না। সৈয়দ আশফাকুল হক কিংবা তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে শিশুদের ওপর কোনো নির্যাতনের যে দৃষ্টান্ত রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি আমরা। সেই সাথে আইনি প্রক্রিয়ায় তার বিচার ও শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

৭. যে দারোয়ানরা বাড়ির মালিকের ইশারায় বা নির্দেশে প্রীতিকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে দেয়নি, তাদেরও নিরপেক্ষ বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এইসঙ্গে ডেইলি স্টারের মৌলভীবাজারের এক প্রতিবেদক এবং প্রীতির মামা ফুলসাই ওরাংকে তদন্তের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

৮. চা বাগান থেকে আনা শিশুদের পাচার করা এবং যৌনদাস করার জন্য কোনো চক্র কাজ করেছে কিনা, সেটাও আলাদাভাবে তদন্ত করে দেখার দাবি জানাচ্ছি।

৯. শিশুশ্রম বিষয়ক নীতিমালাকে আইনে পরিণত করার জোর দাবি করছি। শ্রমে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ১৪ বছরের পরিবর্তে ১৬ বছর করার দাবি করছি সরকারের কাছে। সেই সাথে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালায় গৃহে নিয়োগের ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ১৪ বছরের পরিবর্তে ১৬ বছর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

১০. ২০১৭ সালে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শ্রম মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নিজে গৃহকর্মীদের অধিকার রক্ষায় সারা দেশে মনিটরিং সেল গঠনের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল তা অবিলম্বে কার্যকরের জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে গৃহ শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিটি বাড়ি পরিদর্শনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত, লেখক রেহনুমা আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট তোবারক হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন কণা, লেখক গবেষক প্রিসিলা রাজ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির আবুল হোসেন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, নাসিমুন আরা হক মিনু, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন প্রমুখ।

এএএম/এমএএইচ/জেআইএম

Read Entire Article