গৃহস্থালি প্লাস্টিক সামগ্রীর রপ্তানি বাড়াতে ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ আরএফএল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখল ও চীন থেকে স্থানান্তরিত ব্যবসা আকর্ষণ করাও এ বিনিয়োগের অন্যতম উদ্দেশ্য। এতে নতুন করে অন্তত আড়াই হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
এ বিনিয়োগ করা হচ্ছে গাজীপুরের কালীগঞ্জে আরএফএল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে। কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে এপ্রিল-মে মাস থেকে। নতুন এ কারখানায় বছরে ৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের পণ্য উৎপাদন করা যাবে। নতুন এ বিনিয়োগের ফলে আরএফএল-এর বার্ষিক রপ্তানি বাড়বে ৩০ শতাংশ।
চীনের হাইতিয়ান গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি
গৃহস্থালি প্লাস্টিকপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে চীন থেকে মেশিনারিজ আনার জন্য রোববার (২ মার্চ) চীনের হাইতিয়ান গ্রুপের সঙ্গে আরএফএল গ্রুপের একটি চুক্তি সই হবে। এসময় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
হাইতিয়ান গ্রুপ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্লাস্টিক মেশিনারিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারিজ উৎপাদনের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকপণ্য উৎপাদনের জন্য মানসম্মত ও সর্বাধুনিক মানের ইনজেকশন মডেলিং মেশিন সরবরাহ করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘বিশ্বের ৮০টি দেশে আরএফএল-এর প্লাস্টিক গৃহস্থালি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আরও বেশি দেশে এটা ছড়িয়ে দিতে এ বিনিয়োগ। নতুন যন্ত্রপাতি আনার পর যেসব পণ্য উৎপাদন হবে তার সব পণ্যই রপ্তানি হবে। রপ্তানি বাজার মাথায় রেখেই এই মেশিনারিজ আনা হচ্ছে।’
দেশে নানাবিধ কারণে বিনিয়োগ থমকে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। এর মধ্যে এটি দেশের জন্য খুবই আনন্দদায়ক বার্তা যে বর্তমান প্রতিকূলতার মধ্যেও আরএফএল নতুন একটি কারখানা করতে যাচ্ছে। এটি অল্প সময়ের মধ্যেই হতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে দেশের রপ্তানি সমৃদ্ধ হবে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করবে এবং অতি স্বল্প সময়ে অর্থাৎ, আগামী মে মাসের মধ্যে আড়াই হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।’
আরও পড়ুন
- দেশে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার বাড়ছে
- ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছয় হাজার প্রতিষ্ঠান
- প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ে প্রাণ-আরএফএলের আমদানি সাশ্রয় ৪শ কোটি টাকা
‘গুরুত্বপূর্ণ সুখবর হলো- এই কারখানা কেন্দ্র করে রপ্তানি আদেশ আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ক্রয়াদেশ এসেছে যেটি বেসরকারি খাতে পোশাক খাতের পর সবচেয়ে বড়। শুধু একজন ক্রেতার কাছ থেকেই ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আদেশ এসেছে।’ বলেন কামরুজ্জামান কামাল।
বিদেশে মূলত বিভিন্ন ডিজাইনের গৃহস্থালি পণ্যের চাহিদা রয়েছে। এসব পণ্য আরএফএল তৈরি করবে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের কনটেইনার, টয়েজ, টেবিল ওয়্যার, কিচেন ওয়্যারসহ বিভিন্ন পণ্য।
প্রধান লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধরা
যুক্তরাষ্ট্র প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারকদের জন্য একটি বড় রপ্তানি বাজার। কারণ, সেখানে একটি বড় জনসংখ্যা রয়েছে, যারা ব্যক্তিপ্রতি বছরে প্রায় ১৫০ কেজি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করে।
কামাল বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করারোপে চীনের বাজার থেকে ব্যবসা স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা এ সুযোগ কাজে লাগাতে চাই। যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় বাজার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় ১৫০ কেজি।’
‘ইউরোপের বাজারে আমরা ভালো করছি। এখন আমাদের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভালো করা। এরই মধ্যে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতার কাছ থেকে ছয় মিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ পেয়েছি।’ জানান কামাল।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভালো করতে এবং পণ্য সরবরাহ করতে সার্টিফিকেশনের প্রয়োজন। আমরা স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে কমপ্লায়েন্ট। আমরা বিজনেস সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ইনিশিয়েটিভ (বিএসসিআই) প্রত্যয়িত।’
রপ্তানির চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ের মধ্যে প্লাস্টিকপণ্য থেকে রপ্তানি আয় ২৪ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়ে ১৮২ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৪৬ মিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করেছে ২৪৪ মিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৭ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মূল্যের প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি করেছে। গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ১০ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার।
আরএফএল গ্রুপের রপ্তানির চিত্র
দেশের শীর্ষস্থানীয় গৃহস্থালি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আরএফএল। ২০০৭ সালে ভারতে গৃহস্থালি প্লাস্টিকপণ্য পাঠানোর মাধ্যমে আরএফএল-এর রপ্তানি শুরু হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই আরএফএল গ্রুপের প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি বেড়েছে। রপ্তানিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে আরএফএল-এর প্লাস্টিকপণ্য পাওয়া যাচ্ছে।
এখন ৩০ ক্যাটাগরিতে ৫০০ পণ্য রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালি প্লাস্টিক, বাইসাইকেল, মেলামাইন, গৃহনির্মাণ সামগ্রী, পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, নন-লেদার ফুটওয়্যার, প্লাস্টিক ফার্নিচার। এসব পণ্য রপ্তানি করে আরএফএল গ্রুপ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।
আরএফএল পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ভারতে। এরপর রয়েছে জার্মানি, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, স্পেন, যুক্তরাজ্য এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
যুক্তরাষ্টের ওয়ালমার্ট, কানাডার ডোলারামা এবং লবলোজ, ফ্রান্সের ক্যারিফোর, জার্মানির লিডল, অস্ট্রেলিয়ার টার্গেট, কোরিয়ার লোকসি এবং যুক্তরাজ্যেও উলওয়ার্থস এবং আর্গস-এর মতো প্রসিদ্ধ সুপারশপগুলোতে আরএফএল পণ্য পাওয়া যায়।
আইএইচও/এএসএ/এমকেআর