ফারজানা অনন্যার গল্প: নিঃশেষে বিভাজ্য

2 months ago 34

সুব্রত এলোমেলো পদক্ষেপে হাঁটতে হাঁটতে বেড়িবাঁধের পুরো রাস্তাটা শেষ করে ফেললো। নিঃশেষে বিভাজ্য রাস্তা! সামনে আর পথ নেই। রিক্ত অনন্ত চরাচরজুড়ে রুপালি জলের ঝিলিক। মাথার ওপরে এক মস্ত চাঁদ ঠোঁট বেকিয়ে হাসছে। নীলচে সাদা আকাশ আসন্ন শীতকালের অনিবার্য বৈধব্যের জন্য এখন থেকেই তৈরি হচ্ছে, তার শরীরে গয়না বলতে কিছু নেই। মাথাটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে ওর। হুট করে বসে পড়লো নদীর পাড়ে। সামনেই বয়ে চলা পদ্মা নদী। পদ্মাবতীর গোছানো ছিমছাম সংসার! এই মুহূর্তে নেই অশান্ত রাগী ঢেউয়ের ঝুট ঝামেলা। কী করে কীসব হয়ে গেলো, সুব্রত হিসেব মেলাতে পারে না। দু’হাঁটু ভাঁজ করে মাথাটা আলতো করে রাখে পায়ের ওপর। পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে চিন্তাগুলো।

নদীর হওয়ায় শিরশির করে ওর শরীর। কোথায় যেন পড়েছিল নদী আর হাওয়ার নামে একটা গল্প। মনে করতে পারে না। বাচ্চাদের মতো মাথা চুলকায়। ইতিউতি তাকায়! মনে হয় নামটা মনে পড়াটা খুব জরুরি। নইলে দম আটকে মরে যাবে এমন অবস্থা। অবশেষে নাম মনে পড়ে। শহীদুল জহিরের লেখা গল্প ‘ডলু নদীর হাওয়া’।

নদীর স্রোতকে মনে হয় শ্লথগতি রক্তপ্রবাহের মতো। স্রোত কীসের অনুকূল ও কাদের প্রতিকূলে চলে—কিছুই ঠাহর করতে পারে না সুব্রত। এই মুহূর্তে মন খারাপ করে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে চাইছে সর্বত্র থেকে। কিন্তু প্রত্যাহার করার পদ্ধতি কী, প্রত্যাহার করতে হবে কেন—এসব ব্যাপারে তার স্পষ্ট হয় মস্তিষ্কের করোটিতে!

সুব্রত জানে, মানুষের মস্তিষ্কের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার—চোখের আড়ালে যে থাকে, মানুষ তাকে দ্রুত ভুলে যায়। মস্তিষ্ক নতুন স্মৃতি রাখার জন্য পুরোনো স্মৃতি ধুয়ে ফেলে। কিন্তু এইমাত্র যা ঘটলো, এই স্মৃতি কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে? আবার সুররিয়ালিজমের মাকড়সার জালে আটকে যাচ্ছে ওর জীবনের সরালানন্দ।

পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলির রাস্তায় গরম ভাতের মাড়ের দগদগে ঘা নিয়ে শুয়ে থাকা ভেলুর কুকুরের মতো সুব্রতর জীবন সংগ্রাম। কৃষকের সন্তান সুব্রতর দরিদ্রতার সাথে নিত্য বসবাস। সুব্রত একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থী। তবে মেধা যতটুকু না কলমে লাগায়, তার বেশি ঢালে কণ্ঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থি রাজনীতির সক্রিয় সদস্য। সারাদিন স্লোগান আর বক্তৃতায় যায় সময় কেটে। তা-ও কীভাবে বিভাগে প্রথম স্থান ধরে রেখেছে, তা এক বিপুল বিস্ময়। রাজনীতি আর সাহিত্যের ফিউশনে সোমেন চন্দ, সত্যেন সেন, সমর সেনকে গুরু মানে। যদিও সাহিত্যের অভিপ্রায়ে ওর দ্বারা কলম ধরাটা কখনো হয়ে ওঠেনি। সুব্রতকে সবাই সমীহ করে, কিন্তু কাছে এসে এলোমেলো পাগলটাকে কেউ ভালোবাসবে—এই সাহস করাটা শাশ্বত নম্র বাঙালি মেয়েদের পক্ষে একটু দুরুহই বটে! ওই যে, সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য কিছু ‘গুণীলোক’ থাকে; সহজেই যাদের সাথে মেশা যায়, হেসে কথা বলা যায়; অথচ কেমন যেন চির অধরা। ওরা একটা দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করে রাখে চারপাশে। হয়তো নিজের অজান্তেই। ওইসব গুণীদের সবাই খুব শ্রদ্ধা করে, কিন্তু কাছে গিয়ে একান্ত আপন মানুষ হওয়ার সাহসটুকু করে না।

মানুষ রহস্য পছন্দ করে না। অথচ সুব্রত আগাগোড়া রহস্যে মোড়া আটপৌরে মানুষ। দূর থেকে সুব্রতকে মনে হয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অলংকরণে অত্যন্ত বেশি আচ্ছন্ন, স্বপ্নের আত্মচালনায় অত্যন্ত বেশি মসৃণ! কিন্তু সুব্রত আসলে দূর থেকে অনুভব করা সেসবের কিছুই না। সুব্রতর আত্মার মাঝে একবার সাহস করে প্রবেশ করলে সহজেই নিশ্বাস নেওয়া যায়, সহজেই বিশ্বাস করা যায়। সেই সাহসী পদক্ষেপটা প্রথম নিয়েছিল অন্বেষা। অন্বেষা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। ক্লাস না থাকলে চার তলার উপরে কৃষ্ণচূড়ার ডাল ঘেঁষে মাঝে মাঝেই শান্ত চত্বরে হওয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান খুব মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করতো অন্বেষা। বামপন্থী রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠানে মুক্তমঞ্চে অচেনা-অজানা এলোমেলো এই পাগল ছেলেটার কণ্ঠে যেদিন শুনলো প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের কথা, ‘বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মণি’। ওইদিনই ঠিক করে নিয়েছিল বাদামি চোখের এই মানুষটার সব পাগলামি আর স্বপ্নটুকু কেবল ওর নিজের করে নেবে। এর ভাগ কাউকে বেচা চলবে না। সুব্রত আর অন্বেষার প্রেমটা কীভাবে হলো, আসলে ওরা নিজেরাও জানে না। প্রেম বোধহয় কম, বন্ধুত্বই বেশি। দুজনই দুজনকে ভাই-ভাই বলে ডাকে। আশেপাশের মানুষজন সম্বোধন শুনে আবার চোখ পাকিয়ে তাকায়। কিছু বলে না। তারা জানে, দুজনেই পাগল। এদের কোনো কিছুরই ঠিক নাই!

বাইশ ডিসেম্বর সুব্রত, অন্বেষা আর অন্বেষার কয়েকজন বান্ধবী মিলে ঠিক করলো ওরা মাওয়া ঘাট ঘুরতে যাবে। সন্ধ্যার মধ্যে ফেরার চেষ্টা করবে। অন্বেষা, মুনা, কেয়া আর সুব্রত—চার মূর্তির মাওয়া সফর!

আরও পড়ুন
সায়নদীপার গল্প: কুহক 
তাশফীয়া কাফীর গল্প: ঘোরগ্রস্ত পৃথিবী 

শীতের শেষ দুপুরবেলায় বাহুল্যবর্জিত পদ্মার শূন্যতা—সৌন্দর্য কিংবা ধারালো ঢেউয়ের বর্ণহীন উৎসব দেখতে দেখতে অন্বেষার কেবলই মনে হতে থাকে, ‘মাথায় অনাবৃত আকাশ, চোখের সামনে কূলহারা তটহারা জলধি, মনের সামনে নিরবচ্ছিন্ন অনন্ত একা—একা আমি!’ অন্বেষার প্রায়ই মনে হয় প্রকৃতি, একাকিত্ব আর নির্জনতার মতো উপভোগ্য কিছু নেই। তবে বেশিক্ষণ একা থাকা গেলো না। কেয়ার সুরের মূর্ছনায় ঘোর কাটলো অন্বেষার। অন্বেষার সবচাইতে কাছের বান্ধবী কেয়া। কারণ কেয়া সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী। গানের প্রতি অন্বেষার দুর্বলতা কিংবা অনুরাগের কথা কারোরই অজানা নয়। অন্বেষা ওকে ক্ষেপায় বাংলাদেশের ভবিষ্যত ‘ফেরদৌস আরা’ বলে। কেয়া গুনগুনিয়ে গাইতে থাকে—
‘আমারই মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনায়।’

সুরের পাঁপড়ির সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বর্ণহীন শীতকালে আসে বসন্তের আমেজ। চারজন বিভোর হয়ে শুধু শুনতে থাকে, শুনতে থাকে! সুব্রত যদিও একটু নজরুল সমালোচনার প্রস্তুতি শুরু করছিল, কেন নজরুল কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শকে আশ্রয় না করে ব্যক্তিক পর্যায়ে সাম্যের কথা বললেন তাঁর বিদ্রোহী বা সাম্যবাদী কবিতাগুলোতে! এরজন্যই সাহিত্যে তাঁর মতামত জোরালো হলেও রাজনৈতিক আদর্শে নড়েবড়ে হয়ে রইলো—ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তিনকন্যার চোটপাট শুনে চুপটি করে থাকতে হলো সুব্রতকে। মনে মনে করুণাও হচ্ছিল সুব্রতর। ‘ওহে বালিকাত্রয়, নদীর ধারে নিরিবিলি পরিবেশে কেবল প্রেমের গানই শুনে গেলে। ব্যারিকেড ভেঙে মিছিলে বিদ্রোহী কবিতা আর আওড়াতে পারলে কই!’ মনে মনে বলল। জোরে বললে রক্ষে নেই ওর!

মাওয়া ঘাটে পদ্মার ইলিশ, বেগুন ভাজি খেয়ে ঢেকুর তুলে সন্ধ্যার মেঘমালা দেখতে দেখতে একটা নীল জোছনা রাতে ফিরতি পথে পা বাড়ায় চার বন্ধু! অন্বেষা মজা করে বলে, ‘সুব্রত, আমরা কিন্তু  সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসটা রিপ্রেজেন্ট করছি, তাই না বল? কেবল চরিত্র ভিন্ন। তিন বন্ধু আর একটা বান্ধবীর স্থানে তিন বান্ধবী, এক বন্ধু। দোস্ত, তোকে ‘জয়িতা’ নামে ডাকি? কী বল!’ সুব্রত চোখ পাকিয়ে ভয় দেখায় অন্বেষাকে। ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। সুব্রতর দায়িত্ব তিনজনকে তাদের হোস্টেলে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া।

তবে হুট করেই পৃথিবীর সবচাইতে কদর্য ঘটনাটা ঘটে যায় ওদের চারজনের সামনে। সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী কোনো ব্যক্তির এক বখাটে ছেলে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা একটা মেয়েকে টেনেহিঁড়চে ওঠায় প্রাইভেট কারে। মেয়ের আর্তচিৎকারে ধ্বনিত হতে থাকে চারপাশ। চোখের সামনেই ঘটে ঘটনা। সুব্রত ছুটতে থাকে। অন্বেষা পেছন থেকে হাত টেনে বলে, ‘ওকে বাঁচাতে গেলে আমাদের তিনজনকে হয়তো আজকের পর আত্মহত্যা করতে হবে। তুমি কিছুই করতে পারবে না। কেবল পাশবিক নির্যাতনের শিকার হবো আমরা তিনজন।’

খুব স্বাভাবিক পথচারীদের চলাফেরা। কেউ কেউ হয়তো এই ঘটনা নিত্য দেখে অভ্যস্ত। দুচোখে রক্ত জমাট বাধে সুব্রতর। পায়ের পাতা হয়ে আসে অসাড়! ওদের তিনজনকে হোস্টেলে রেখে এসে সুব্রত মধ্যরাতে নির্জন ব্যস্তহীন রাস্তায় বসে পড়ে।

এই নাকি সুব্রত বড়ুয়া? যাকে সবাই বিপ্লবী ‘কমরেড’ বলে। সোমেন চন্দের ছবি ঘরে টানিয়ে দুই বেলা যে প্রণাম করে! ঘৃণা হয় ওর নিজের প্রতি। লেনিন, মার্কস, এঙ্গেলস, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, লিওন ট্রটস্কি, স্ট্যালিন, চে গুয়েভারা, মাও সেতুং, মুজফ্‌ফর আহমদ, ভাসানী, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, সর্বহারা শ্রেণি, বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত, সংগ্রাম, বক্তৃতা, ম্যাক্সিম গোর্কি, মহাশ্বেতা দেবী, সুভাষ, সুকান্ত, রণেশ দাশগুপ্ত, বদরুদ্দীন উমর—সব নিমেষে তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, মিথ্যা হয়ে যায়। শূন্য হয়ে যায়! অনুভূত হয় সব গালভরা বুলি। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে ও কেবল একটা ইঁদুর। সোমেন চন্দের গল্পের মতো ‘ইঁদুর’। যে ইঁদুর দুর্বল, অসহায়; যে ইঁদুরের ক্ষমতা নেই একটা নিঃসহায় মেয়ের সম্ভ্রম কিছু পাষণ্ডের থেকে রক্ষা করার। নিজেকে ভণ্ড মনে হয় ওর। ওর কানে বাজে চিৎকার... সেই অসহায় চিৎকার... সম্ভ্রম বাঁচানোর তীব্র আর্তনাদ... ড্রামের শব্দের মতো বেজেই চলে, বেজেই চলে।

সুব্রত আবার মাওয়াঘাটে রওয়ানা করে। একটা নীল জোছনা রাত। হাঁটতে হাঁটতে বেড়িবাঁধের শেষ মাথায় নিঃশেষে বিভাজ্য রাস্তা শেষে অনন্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে! নদীর কলধ্বনির সাথে সাথে আরেকটা শব্দ ক্রমাগত বেজেই চলে ওর কানে! বেজেই চলে! ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে ওঠে। মোমের মতো গলে গলে পড়ে রাত্রির নির্জনতা। গ্রাস করে যন্ত্রণাময় চিৎকারের ধ্বনি।

পরদিন সর্বপ্রথম গ্রামের ছোট্ট মেয়ে মুনিয়া তার মায়ের সাথে নদীতে পানি নিতে এসে আবিষ্কার করে সৌম্য সুন্দর এক ছেলে পানিতে ভেসে আছে! বলা যায় যেন ঘুমিয়ে আছে। যেমন শান্তির আশায় মাতৃক্রোড়ে নিশ্চিতে ঘুমিয়ে থাকে অসহায় পরাজিত কোনো সংগ্রামী সন্তান।

এসইউ/

Read Entire Article