চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার চালানের ৯৮ শতাংশ পরিচালিত হয়। দেশের মোট রপ্তানি পণ্যের ৮২ শতাংশই হলো তৈরি পোশাক। পোশাকের ৫১ শতাংশ ইউরোপে, ২৫ শতাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ২০ শতাংশ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এবং ৪ শতাংশ রপ্তানি হয় কানাডায়।
এরমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের বেশিরভাগ বন্দরে সরাসরি জাহাজ পরিচালিত হয় না। ফিডার বন্দর হিসেবে সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা এবং মালয়েশিয়ার চারটি বন্দর ঘুরে জাহাজ পরিবর্তন হয়ে রপ্তানি পণ্য গন্তব্যে যায়। অন্যদিকে, আমদানিকৃত অনেক পণ্য মাদার ভ্যাসেল করে এসব বন্দর ঘুরে ফিডার ভ্যাসেল হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে।
সম্প্রতি জাহাজ জট কমাতে চট্টগ্রাম বন্দর বহির্বিশ্বের ফিডার বন্দরগুলোতে চলাচলরত ১৫টি কনটেইনার জাহাজ সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে অন্যতম স্টেকহোল্ডার বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের। সর্বশেষ বুধবার বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দ্বন্দ্বের চিত্র আরও স্পষ্ট হয়েছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, চার-পাঁচ মাস আগে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থার সময় ফিডার রুটগুলোতে এডহক ভিত্তিকে অনুমতি দেওয়া জাহাজগুলো সংকটকাল পেরোনো পরও নির্ধারিত রুটগুলোতে অপারেশনে থাকছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে জাহাজ জট।
দেশের বেশিরভাগ বন্দরে সরাসরি জাহাজ পরিচালিত হয় না। ফিডার বন্দর হিসেবে সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা এবং মালয়েশিয়ার চারটি বন্দর ঘুরে জাহাজ পরিবর্তন হয়ে রপ্তানি পণ্য গন্তব্যে যায়
তবে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, বন্দর ও কাস্টমসের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে জাহাজের গড় অবস্থানকাল বেড়েছে।
বন্দর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রধানতম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন ফিডার রুটে জাহাজের সংখ্যা বাড়ায় জাহাজ জটসহ শিপিং বাণিজ্যে সংকট তৈরি হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ২০ জুলাই বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে।
আরও পড়ুন
- মোংলা বন্দরের ব্যবহার বাড়ালে চট্টগ্রামের যানজট কমবে
- চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ৮.২২ শতাংশ
- চট্টগ্রাম বন্দরে দৈনিক গড় কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে
পরে ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনকে ফিডার রুটে চলাচলরত ১৫টি কনটেইনার জাহাজ কমাতে সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে শিপিং ব্যবসায় জড়িতদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়।
৬ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের ৯৮ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। এ বন্দরে বিদ্যমান সুবিধায় ৯৫-১০৫টি জাহাজ ফিডার রুটগুলোতে চলাচল করলে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং বন্দর ফ্যাসিলিটিজের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়েক মাস আগে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি অবনিত হওয়ার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আমদানি-রপ্তানিকারকদের সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে আসছিল। আমদানি পণ্য যথাসময়ে পাওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি পণ্যও নির্ধারিত সময়ে জাহাজীকরণ করতে পারতেন ব্যবসায়ীরা। তখন জাহাজের অপেক্ষমান সময়ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। বেশিরভাগ জাহাজই সরাসরি জেটিতে বার্থিং পেয়ে যেত।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, চার-পাঁচ মাস আগে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা শুরু হলে ফিডার বন্দরগুলোতে বাংলাদেশমুখী কিছু আমদানি কনটেইনারের জট তৈরি হয়। এতে এসব রুটের ফিডার জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু জাহাজ এডহক ভিত্তিতে চালানোর অনুমতি চান।
চার-পাঁচ মাস আগে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা শুরু হলে ফিডার বন্দরগুলোতে বাংলাদেশমুখী কিছু আমদানি কনটেইনারের জট তৈরি হয়। এতে এসব রুটের ফিডার জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু জাহাজ এডহক ভিত্তিতে চালানোর অনুমতি চান
তখন আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থে ফিডার বন্দরের জমে থাকা কনটেইনারের জট কমানোর জন্য ফিডার অপারেটরদের তাদের নিজস্ব বহরে থাকা জাহাজের অতিরিক্ত হিসেবে প্রায় ২০-২২টি জাহাজকে সাময়িক চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ফিডার পোর্টগুলোতে জমে থাকা কনটেইনারের জট সেড়ে গেলেও ফিডার অপারেটররা সাময়িক অনুমোদন পাওয়া অতিরিক্ত জাহাজগুলো ফিডার রুটগুলো থেকে প্রত্যাহার করেননি।
এতে ফিডার পোর্টগুলোতে চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা প্রায় ১৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এতে করে বহির্নোঙরে জাহাজের অপেক্ষমান সময়, অপেক্ষমান জাহাজের সংখ্যা এবং জেটিতে জাহাজের কার্যকালীন সময় আগের তুলনায় বেড়েছে। ফলে আমদানি ও রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য হাতে পেতে এবং জাহাজীকরণ করতে বিলম্বের মুখে পড়ছেন। পাশাপাশি চলাচলকারী জাহাজগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী পূর্ণমাত্রায় কনটেইনার পাচ্ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০ জুলাইয়ের বৈঠকে অংশ নেওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফিডার রুটগুলো থেকে জাহাজ কমানো ওইদিনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বৈঠকে বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা ছিলেন। ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে ১৫টি জাহাজ কমিয়ে তার তালিকা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তারা এখনো একটি জাহাজও কমাতে পারেননি কিংবা কমাননি।’
তিনি বলেন, ‘বন্দরে জাহাজ চলাচলের সংখ্যা বাড়লে বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বাড়তে থাকে। তাছাড়া জেটিতে থাকা জাহাজে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য কিংবা কনটেইনার লোড-আনলোড সম্পন্ন করা না গেলে সিডিউল অনুযায়ী জাহাজ গন্তব্যে ছেড়ে যেতে পারে না। এতে জাহাজের ‘টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম’ বেড়ে যায়।’
‘বর্তমানে বিভিন্ন ফিডার রুটে জাহাজ বেড়ে যাওয়ায় বহির্নোঙরে জাহাজের ওয়েটিং টাইম বাড়ছে, অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যাও বাড়ছে। এতে বর্হিবিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে’- যোগ করেন ওই কর্মকর্তা।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে একই সঙ্গে ১৬টি জাহাজ বার্থিং দেওয়া সম্ভব হয়। তবে একসঙ্গে ১০টির বেশি কনটেইনার জাহাজ বন্দরে বার্থিং দেওয়া সম্ভব হয় না। চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল ছিল এক থেকে দুইদিন।
জাহাজ কমালে বর্হিবিশ্বে বন্দরের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আমদানি-রপ্তানির খরচ আরও বাড়বে, ব্যবসা বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই এখন বন্দরের উচিৎ ফিডার রুটগুলোতে জাহাজ না কমিয়ে চলাচলরত জাহাজগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেওয়া।- সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ
এ বিষয়ে কথা হলে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন। ব্যবসায় প্রতিযোগিতা থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দরেও ঠিক তা-ই। এখানে ব্যবসায়ীরা জাহাজ আনছেন। ফিডার রুটগুলোতে যারা জাহাজ পরিচালনা করছেন, তারা যদি মনে করেন লোকসান হচ্ছে, তাহলে তারা জাহাজ সরিয়ে নেবেন। এখানে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা। বন্দরের উচিত ব্যবসায়ীদের আগ্রহকে কাজে লাগানো। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ উল্টো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু জাহাজের কারণে বন্দরে টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বাড়ছে না। বন্দর কাস্টমসের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ে খালাস ও শিপমেন্ট করা যায় না। বিশেষ করে গত দুই মাসে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি কর্মসূচি ছিল, অফডকগুলোতে ট্রেইলার চালকদের কর্মবিরতি ছিল, আবার এনসিটির অপারেশন হ্যান্ডওভার নিয়ে জটিলতা হয়েছে, বর্ষাকাল যাচ্ছে।’
‘ফলে এসব কারণে নির্ধারিত সময়ে জাহাজ খালাস ও শিপমেন্ট হয়নি। এতে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বেড়েছিল। এখন সমস্যাগুলো কেটে যাওয়ায় ধীরে ধীরে টার্ন অ্যারাউন্ড টাইমও কমে আসছে। সামনে আরও কমবে।’
আরও পড়ুন
- ৬ মাসের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে নৌবাহিনী
- রেকর্ড ৭৫৪৩২ কোটি টাকার রাজস্ব, তবুও পূরণ হয়নি লক্ষ্যমাত্রা
বন্দর কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাহাজ কমালে বর্হিবিশ্বে বন্দরের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আমদানি-রপ্তানির খরচ আরও বাড়বে, ব্যবসা বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই এখন বন্দরের উচিৎ ফিডার রুটগুলোতে জাহাজ না কমিয়ে চলাচলরত জাহাজগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেওয়া।’
জানতে চাইলে বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরের যে ইয়ার্ড স্পেস, ইক্যুপমেন্ট, কনটেইনার জাহাজগুলোর ভয়েজ ফ্রিকোয়েন্সি রয়েছে এবং আগামী ৪-৫ বছরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের আগামী পাঁচ বছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনা হিসাব করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফিডার রুটগুলোতে ৯৫-১০৫টি জাহাজ চলাচল করলে একটি ভারসাম্য থাকবে।
‘এছাড়া ফিডার পোর্টগুলো থেকে আমদানি কনটেইনারের জট কমানোর জন্য এডহক ভিত্তিকে ২০-২২ জাহাজ সাময়িক চলাচলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন ফিডার পোর্টগুলোতে সেই সমস্যা কেটে গেছে। উপরন্তু অপারেটররা সাময়িক অনুমোদন নেওয়া এডহক জাহাজগুলো সরিয়ে না নেওয়ায় নতুন করে জটিলতা হচ্ছে। বিশেষত চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বাড়ছে। তাছাড়া জাহাজগুলো ফুল ক্যাপাসিটিতে কনটেইনার পাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, এ জটিলতা কাটানোর জন্য ২০ জুলাই ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশন এবং শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার আগে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কয়েকটি সংগঠন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে এমন কিছু তথ্য দিয়েছে যা অনভিপ্রেত।
এমডিআইএইচ/এমকেআর/এমএস