ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে ক্যারিয়ার কেমন হবে?

6 hours ago 3

মানবজীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য। তবে শুধু খাদ্য গ্রহণই যথেষ্ট নয়—তা হতে হবে নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং দীর্ঘস্থায়ী। আধুনিক সভ্যতায় এ চাহিদা পূরণে খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনে প্রযুক্তির ব্যবহার একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং। বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পুষ্টির ঘাটতি মোকাবিলায় এ টেকনোলজির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে কী? এ টেকনোলজির কাজ কী? এ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার বা কর্মসংস্থান কেমন হতে পারে? এ ছাড়া আরও প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন—

ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং কী
ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির মধ্যে ফুড টেকনোলজি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যার সমন্বয়ের মাধ্যমে খাদ্যকে নিরাপদ, পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়। এ টেকনোলজির আওতায় খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং এবং পরিবহন—প্রতিটি ধাপে অত্যাধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল জ্ঞান প্রয়োগ করা হয়। এর প্রধান লক্ষ্য—খাদ্যের পুষ্টিমান বজায় রেখে তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য করে তোলা এবং স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

এ টেকনোলজির বিশেষজ্ঞরা বয়স, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন রোগের ধরন বিবেচনায় নিয়ে উপযুক্ত খাদ্য নির্ধারণ ও উন্নয়নে কাজ করেন। ফলে এটি শুধু প্রযুক্তিনির্ভর একটি ক্ষেত্রই নয় বরং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মানুষের সুস্থ জীবনধারার জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান হলো নিরাপদ খাদ্য। এ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ফুড টেকনোলজি অনন্য ও অপরিসীম সম্ভাবনাময় শাখা হিসেবে কাজ করছে।

ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যেসব বিষয় পড়ানো হয়:

খাদ্য রসায়ন
খাদ্যের উপাদান যেমন কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন ও খনিজের গঠন ও বৈশিষ্ট্য। খাদ্যের গুণগত পরিবর্তন এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া।

খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ
খাদ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি। তাপ, চাপ, শুষ্কতা, জমাট বাঁধানো ও ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়া।

খাদ্য প্রকৌশল
তাপ পরিবহণ, ভর পরিবহণ এবং শক্তি প্রয়োগের নীতিমালা। প্রক্রিয়াজাত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের নকশা ও কার্যকারিতা।

খাদ্য সংরক্ষণ ও প্যাকেজিং
খাদ্যের পচনরোধ, রেফ্রিজারেশন, পাস্তুরাইজেশন, ক্যানিং ইত্যাদি পদ্ধতি। খাদ্য মোড়ক ডিজাইন, মোড়কের উপাদান ও ব্যবহারযোগ্যতা।

এ ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা ও গুণগত মান, খাদ্য জৈবপ্রযুক্তি, খাদ্য রসদ ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও অটোমেশন, পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য।

ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভবিষ্যৎ কেমন
বিশ্বের জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বাড়তি জনসংখ্যার জন্য নিরাপদ, পুষ্টিকর ও সুলভ মূল্যে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। ঠিক এখানেই ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের ভূমিকাটি হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত প্যাকেজিং, আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং উৎপাদন প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্যের অপচয় রোধ, সংরক্ষণের সময় বৃদ্ধি এবং পরিবহনে সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। এ জন্য দেশ ও বিদেশে খাদ্যশিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি, খাদ্যভিত্তিক পরোক্ষ খাতেও গড়ে উঠছে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ। প্রযুক্তিগত অটোমেশন ও খাদ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে দক্ষ ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা এখন অনেক বেড়ে গেছে।

আরও পড়ুন
প্রকৌশল ছেড়ে বিসিএস ক্যাডার হলেন তানভীর
ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার উপায়

খাদ্য ছাড়া পৃথিবী সচল নয়। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য নিরাপদ ও মানসম্মত খাদ্য অপরিহার্য। শুধু মানুষের জন্যই নয়, গৃহপালিত পশুপাখির ক্ষেত্রেও নিরাপদ খাদ্য প্রয়োজন। সব মিলিয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংকে একটি সম্ভাবনাময় ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পেশা হিসেবে ধরা হয়।

কর্মসংস্থান কেমন
বর্তমান বিশ্বে পুষ্টিমান বজায় রেখে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করছেন ফুড ইঞ্জিনিয়াররা। ফুড প্রসেসিং, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং, গুণমান নিয়ন্ত্রণ এবং সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনায় তাদের ভূমিকা অপরিসীম। সরকারির পাশাপাশি বেসরকারিভাবেও ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। বিশেষ করে ফুড প্রোডাকশন কোম্পানি, ডেইরি ও বেভারেজ শিল্প, ফাস্ট ফুডসহ খাদ্য আমদানি-রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

উন্নত দেশগুলোয় রেস্টুরেন্ট, ক্যাটারিং সার্ভিস ও নামিদামি হোটেলের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি খাদ্যের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন—যেখানে ফুড ইঞ্জিনিয়াররাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী কোম্পানিতে অনেক বাংলাদেশি ফুড ইঞ্জিনিয়ার সফলভাবে কর্মরত আছেন। আগামী দিনে খাদ্যশিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এ টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে।

সরকারি চাকরি
১. বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
২. বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন
৩. খাদ্য অধিদপ্তর
৪. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
৫. বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন
৬. বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।

বেসরকারি চাকরি
১. খাদ্যপ্রক্রিয়াজাত শিল্প
২. মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগত পরীক্ষা প্রতিষ্ঠান
৩. প্যাকেজিং ও রিসার্চ বিভাগ
৪. বিপণন ও বিক্রয়।

অন্য ক্যারিয়ার
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিং সেন্টারেও চাকরি করতে পারবেন। এ খাতে আছে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে ফুড প্রসেসিং, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, হিমায়িত খাদ্য (ফ্রোজেন ফুড), অর্গানিক ফুড বাজারজাত করে সফল হওয়ার সুযোগ আছে। গবেষণার মাধ্যমেও নিজেকে প্রমাণ করা যায়। এ ছাড়া মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ (ফিশ প্রসেসিং), শুঁটকি উৎপাদন, রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি শিল্পসহ বিভিন্ন উপখাতে ফুড ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য আছে বিপুল কর্মসংস্থান। ভালো দক্ষতা, নতুন প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা থাকলে এ টেকনোলজি নিয়ে দেশ কিংবা বিদেশে সহজেই উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সম্ভব।

কারা পড়বেন
ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং তাদের জন্য; যারা বিজ্ঞানে দক্ষ এবং খাদ্য, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। যাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ আছে, নতুন কিছু উদ্ভাবনের ইচ্ছা আছে এবং সমস্যা সমাধানে সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা করার সক্ষমতা আছে। তাদের জন্য এ টেকনোলজি উপযুক্ত। তবে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে হলে অবশ্যই পরিশ্রম, ধৈর্য ও দলবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে।

কোথায় পড়বেন
যদি ফুড ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমা ফুড ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, তাহলে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। ডিপ্লোমা ইন ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। ডিপ্লোমা শেষে সরকারিভাবে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) বিএসসি করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি করা যায়।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article