ফ্যাসিস্ট পতনের বর্ষপূর্তি : কী পেলাম কী পেলাম না

1 month ago 8

পতন আর বিদায় এক নয়। ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের এক বছর পূর্তিতে তা আবার প্রমাণিত। এক বছর সময়ের ব্যবধানে মূল্যায়ন করা একটু জটিল হলেও অসম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান স্বস্তির বিষয়। আবার ফ্যাসিস্ট শাসনের পরবর্তীসময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা অর্জন, গণতন্ত্রের ভিত্তি পুনর্নির্মাণ কঠিন ও চ্যালেজ্ঞিং। ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসানের পর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে আসে, বাংলাদেশেও বেশ এসেছে। জনগণ তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়, যতদূর হোক সেটাও মিলেছে। প্রশ্ন ভিন্নখানে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার ব্যবহারটি অপব্যবহারে চলে যাচ্ছে কি না? মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে যা ইচ্ছা বলা হচ্ছে কি না? মর্যাদা থাকছে স্বাধীনতা শব্দটির?

ফ্যাসিবাদ পতনের পর অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের একটা সুযোগ আসে। তা বিশ্বের দেশে দেশে দেখা গেছে। ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনীতি বা মিশ্র অর্থনীতির দিকে যাত্রা শুরু হতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে সহায়ক হয়। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৈরি হয় সংস্কার ও পরিবর্তনের সুযোগ। বিপরীতে কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা দেয়। ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা যেতে পারে। দেখা দেয় অর্থনৈতিক সংকট। সামাজিক বিভাজনও ভর করে। সম্ভাবনা ও শঙ্কার এ দুই সন্ধিক্ষণেই এখন বাংলাদেশ।

ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের ইতিহাস দীর্ঘ এবং এটি অনেক উৎস থেকে আকৃষ্ট। ফ্যাসিস্টরা আরও অনেককে নিয়ে-দিয়েই ফ্যাসিস্ট হন। অল্প বা দীর্ঘসময় জনপ্রিয়তাও পান। সমর্থন আদায়ের নানান কৌশল নেন। তাদের অনেক ল্যাসপেন্সার-অলিগার্ক তৈরি হয়। ওই বেনিফিশিয়ারিরা তাদের টিকিয়ে রাখতে বিস্তর অবদান রাখেন। ক্ষমতা অর্জন এবং বজায় রাখার জন্য ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীল শক্তির সাথে বাস্তববাদী কৌশলগত জোটও করে। ফ্যাসিবাদীরা উদারনীতিকে মানুষকে আধ্যাত্মিকতা থেকে মুক্ত করে এবং তাদের বস্তুবাদী সত্তায় রূপান্তরিত করার জন্য অভিযুক্ত করে যাদের সর্বোচ্চ আদর্শ অর্থ উপার্জন। হিটলার-মুসোলিনি থেকে সাদ্দাম-হাসিনা পর্যন্ত ঘটনা প্রায় কাছাকাছি। বিদায়ের পথপরিক্রমাও হয় দুঃখজনক। তাদের পতনের পর দেশে দেশে যা ঘটে বাংলাদেশেও এখন সেই দৃশ্যপট।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পুরো বাংলাদেশের মানুষ দেখেছিল, সেই স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। সরকারটি দিন পার করছে নানান তাপে ও তোপে। কেউ সংস্কার কমিশনগুলোকে সরকারের সাফল্য হিসেবে দেখছে। কেউ দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, চাঁদাবাজি পুরোপুরি বন্ধ না হওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতিবাচক দিক হিসেবে দেখছে। উভয় দেখাই সঠিক। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট উৎখাতের আন্দোলন শুরু হয়েছিল শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে। পরে এটি রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। এক পর্যায়ে এটি ঠেকে সরকার পতনের এক দফায়।

চিরতরে ফ্যাসিবাদ বিদায়ের উপায় হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা। পাশাপাশি বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছ নির্বাচন এবং জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং ফ্যাসিবাদ জন্মানোর ফাঁক-ফোকর বন্ধ করে। নইলে ফ্যাসিবাদ থাকবে কোনো না কোনো নামে বা ফরমেটে। কঠিন অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ বিদায়ের সম্ভাবনা আর ফ্যাসিবাদ জিইয়ে রাখা- দুই চারণভূমিই বিদ্যমান।

বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলোপের জন্য নিশ্চিতভাবেই কাজ করছে কিংবা ভবিষ্যতে করবে। সরকারপ্রধান পরিষ্কারভাবেই বলেছেন, ছাত্ররা তাকে চাকরি দিয়েছেন। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোরও ভূমিকা ছিল, যারা এর আগে শত চেষ্টার পরও স্বৈরাচারী সরকার পতনে ব্যর্থ হয়। ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে তারা কুলিয়েও উঠতে পারেনি। এখন তারাও নিজেদের মতো কৃতিত্ব নিতে চাইছে, চাইবে-এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলোর বিশাল ভূমিকা ছিল এই আন্দোলনকে সফল করতে।

এ নিয়ে বিতর্ক ও কৃতিত্বের হক দাবি করা নিয়েও এক ধরনের ফ্যাসিবাদের ঝড় বইছে। উভয়ের মধ্যেই চরম অসহিষ্ণুতা। নিকটবর্তী দেশ শ্রীলঙ্কায়ও বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি হয়েছে। বছর দুয়েকের মধ্যে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের দেশ জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেও কিন্তু তারা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে এখন শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সামনে নতুন বাস্তবতা। আছে সম্ভাবনাও। গোলমাল বাধছে প্রথাগত ও নতুন ধারণায়। সেখানে বোঝাপড়া-সমঝোতার বদলে পরস্পর আক্রমণ। প্রকারান্তরে আরেক ফ্যাসিজম।

কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অর্জন নস্যাতের চেষ্টায় নেমেছে। তারা তাদের ইচ্ছা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে এবং চরমপন্থা অবলম্বন করে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে। এসব বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা ও বিভাজন সৃষ্টির প্রচেষ্টার ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকার, ছাত্র নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে নানান ন্যারেটিভ তৈরি করছে। তা হলে শেখ হাসিনা বা ফ্যাসিস্ট কী দোষ করেছে-এমন কথা প্রকাশ পাচ্ছে। এ ধরনের ন্যারেটিভে ফ্যাসিবাদে ঘৃণার পাশাপাশি অভ্যস্ততা বা আসক্তির ছাপ স্পষ্ট। কোনো দেশে বা সমাজে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে জনগণের বড় অংশের মধ্যে ফ্যাসিবাদপন্থি মতামত বর্তমান থাকে।

শুনতে যার কাছে যেমনই লাগুক শেখ হাসিনা ওই সূত্রেই ক্রমশ ফ্যাসিবাদী হয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে ব্যবহার করেছেন। নিজেকে তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যা তার জনপ্রিয়তার অন্যতম হাতিয়ার ছিল। পাশাপাশি তিনি গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছিলেন তার ক্ষমতা ও আদর্শ প্রচার করতে এবং জনগণের মনে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দিতে।

উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অবিরাম কর্তৃত্ববাদ চালিয়েছেন। আশা ছিল ৪১ সাল পর্যন্ত টেনে নেওয়ার। প্রকারান্তরে আজীবনই থাকার বাসনা। জনগণের একটি বিরাট অংশের সমর্থনও তারা হাতিয়েছে। তাদের দিয়ে বলানো হয়েছে, বার বার দরকার শেখ হাসিনার সরকার। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন লাগে না। আগে উন্নয়ন, পরে নির্বাচন বা গণতন্ত্র-এমন কথাও চলেছে। এত টাকা খরচ করে কীসের নির্বাচন –এমন কথাও বাদ যায়নি। মোটকথা তার ফ্যাসিবাদে এগিয়ে যাওয়ার পথে লাইক-কমেন্টস অভাব হয়নি। ফলোয়ার তো অগুনতি। ফ্যাসিবাদ আসক্ত ও প্রভাবিত দেশ-সমাজে এটাই হয়।

সমাজে ফ্যাসিবাদ থাকলে রাষ্ট্রে বারবার ফ্যাসিবাদ ফিরে আসে। আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারতো না, যদি জনগণের এমন অংশটির মধ্যে ফ্যাসিবাদের আসক্তি না থাকতো। এই আসক্তি সহজে যায় না। ফ্যাসিবাদ যেমন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তেমনি সমাজ থেকে ফ্যাসিবাদ নির্মূল করতেও দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

চিরতরে ফ্যাসিবাদ বিদায়ের উপায় হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা। পাশাপাশি বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছ নির্বাচন এবং জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং ফ্যাসিবাদ জন্মানোর ফাঁক-ফোকর বন্ধ করে। নইলে ফ্যাসিবাদ থাকবে কোনো না কোনো নামে বা ফরমেটে। কঠিন-অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ বিদায়ের সম্ভাবনা আর ফ্যাসিবাদ জিইয়ে রাখা- দুই চারণভূমিই বিদ্যমান।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএফএ/জিকেএস

Read Entire Article