বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দিতে অন্তত ছয়মাস আগে কাজ শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এবার মে মাস থেকেই শুরু করা হয়েছিল কাজ। লক্ষ্য ছিল নভেম্বরের মধ্যে ছাপা শেষ করে ডিসেম্বরে সব উপজেলায় পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া।
তবে সেপ্টেম্বরে এসেই এনসিটিবির সেই লক্ষ্যে ছেদ পড়েছে। সিন্ডিকেট ভাঙতে টেন্ডার বাতিলে পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংকট। ফলে বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পাঠ্যবই ছাপা-বিতরণ ঘিরে বিগত ১৫ বছরে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তাদের জনবল ও সক্ষমতা বেশি। তাদের এড়িয়ে যথাসময়ে বই ছাপার কাজ শেষ করাটা কষ্টসাধ্য। অন্তর্বর্তী সরকার এ সিন্ডিকেট ভাঙতে তিন শ্রেণির ১২ কোটি ৬১ লাখেরও বেশি পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার বাতিল করে।
সরকারের পরিকল্পনা ছিল—আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে সিন্ডিকেট ভাঙা অথবা নিয়ন্ত্রণে আনা। শেষ পর্যন্ত তাতে ব্যর্থ হয়ে আবারও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুযোগ রেখে পুনরায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। ফলে সিন্ডিকেট ভাঙার ‘ব্যর্থ’ প্রচেষ্টায় সংকটে পড়েছে এনসিটিবির পুরো কার্যক্রম। ভেস্তে গেছে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পাঠ্যবই ছাপা শেষ করার পরিকল্পনাও।
বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও কারসাজি ঠেকাতে এনসিটিবির অনেকগুলো হাতিয়ার আছে। সেগুলো ব্যবহার করলেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হুট করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়াটা সমাধান নয়। এতে দেশীয় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।- মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান
তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবিরের দাবি, ‘এ বছর হাতে সময় নিয়ে কাজ শুরু করায় টেন্ডার বাতিল করে পুনরায় টেন্ডার আহ্বান করলেও কোনো সংকট তৈরি হবে না। যথাসময়ে শিক্ষার্থীরা বই পাবে।’
কোন শ্রেণির কত বইয়ের টেন্ডার বাতিল
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য মোট ২৯ কোটি ৮৯ লাখের কিছু বেশি বই ছাপা হবে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের বইয়ের সংখ্যা ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজারের কিছু বেশি। আর মাধ্যমিক স্তর অর্থাৎ ষষ্ঠ থেকে নবমের বইয়ের সংখ্যা ২১ কোটি ৪০ লাখের মতো। জুলাই মাসজুড়ে সব শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল এনসিটিবি। জমা পড়া টেন্ডারের আবেদনগুলো মূল্যায়ন করে তা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল।
গত ১৯ আগস্ট ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটির ৩২তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মাধ্যমিকের বইয়ের অনুমোদন দেওয়ার কথা ছিল। সভায় আলোচনার পর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্ঠম শ্রেণির ২৯০ লটে ১২ কোটি ৬১ লাখ ৪১ হাজার ২৯৬ কপি বইয়ের ক্রয়াদেশের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তার মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির বই সংখ্যা ৪ কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৬ কপি, সপ্তম শ্রেণির ৪ কোটি ১৫ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯২ এবং অষ্টম শ্রেণির ৪ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮ কপি।
- আরও পড়ুন
- পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় শেখ হাসিনার ‘স্বৈরতন্ত্র-গণহত্যা’
- এক বছরে পাঠ্যবইয়ের চাহিদা কমেছে ১০ কোটি
- পাঠ্যবইয়ে নিম্নমানের কাগজ আর নয়, বাধ্যতামূলক হচ্ছে জলছাপ
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্রয় কমিটিতে অনুমোদন না দেওয়ার অর্থই সে টেন্ডার বাতিল। তবে কমিটি কেন এনসিটিবি থেকে মূল্যায়ন করে পাঠানো টেন্ডারের ক্রয়াদেশ অনুমোদন করেনি, তা জানানো হয়নি।
যে কারণে টেন্ডার বাতিল
১৯ আগস্টের সভায় ক্রয়াদেশ অনুমোদন না দিয়ে টেন্ডার বাতিল করা হলেও তা এনসিটিবিকে জানানো হয় মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর)। তবে তাতে টেন্ডার বাতিলের সুনির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি। শুধু পুনরায় টেন্ডার আহ্বান করার কথা বলা হয়েছে।
জানুয়ারিতে শিক্ষাবর্ষ শুরু করলে পাঠদানের জন্য বেশি সময় পাওয়া যায়। তবে পাঠদান বা শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে শিক্ষার্থীদের হাতে অবশ্যই পাঠ্যবই পৌঁছানো জরুরি।- মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান
নাম প্রকাশ না করে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, বিগত সরকারের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাব্বানী জব্বারের ছাপাখানা আনন্দ প্রিন্টার্স লিমিটেডকে বই ছাপার কাজ দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া এনসিটিবিতে জমা পড়া টেন্ডার মূল্যায়নে যারা বই ছাপার কাজ পেয়েছিলেন, তাদের অনেকে আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও সরাসরি জড়িত। তারা সিন্ডিকেট করেছে বলেও গোয়েন্দা তথ্য ছিল। এসব কারণে তিনটি শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের অনুমোদন না দিয়ে তা বাতিল করা হয়।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে যার ছাপাখানায় ভালো মেশিন বেশি ছিল, তাকে বেশি কাজ দেওয়া হতো। অর্থাৎ, সক্ষমতা দেখে কাজ দিতো সরকার। দীপু মনি সেই শর্ত বাতিল করে দেন। এটি মুদ্রণশিল্পে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও কারসাজি ঠেকাতে এনসিটিবির অনেকগুলো হাতিয়ার আছে। সেগুলো ব্যবহার করলেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হুট করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়াটা সমাধান নয়। এতে দেশীয় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।’
আন্তর্জাতিক টেন্ডার নয়, কাজ পাচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানই
বিপুলসংখ্যক পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার বাতিলের পর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে এবার আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হবে। এতে মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দাবি, চীন, কোরিয়া ও জাপানে বই ছাপানোর কাগজের দাম তুলনামূলক অনেক কম। ফলে এ কাজ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যত কম দামে করতে পারবে, তা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব নয়। ফলে সব কাজ বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাবে।
আমরা এবার হাতে অনেক সময় নিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম। কোনো ত্রুটি বা পুনরায় টেন্ডার করলেও যাতে খুব বেশি পিছিয়ে না যায়, সেদিকে আমাদের নজর ছিল। সরকারও বই ছাপার কাজকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। পুনরায় টেন্ডার হলেও কাজ শেষ করতে দেরি হবে না। এবার যথাসময়ে শিক্ষার্থীরা বই পাবে।- এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরী
অভিযোগ রয়েছে, পাঠ্যবইয়ের কাজ করতে আন্তর্জাতিক টেন্ডার না দিতে মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হন। তারা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেন-দরবার শুরু করেন। একই সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শ্রমিক উইংয়ের কিছু নেতাকর্মীকে দিয়ে এনসিটিবির সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি করান। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে কাউকে বই ছাপার কাজ দিলে এনসিটিবি ঘেরাও এবং কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও কর্মসূচি থেকে হুঁশিয়ার দেওয়া হয়।
অন্যদিকে মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের তদবিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। বাধ্য হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক টেন্ডারের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানই টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পাবে।
গত ৩১ আগস্ট এক বিজ্ঞপ্তিতে এনসিটিবি জানায়, সম্প্রতি কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তথ্যের সঠিকতা যাচাই না করে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবরের যথার্থতা না থাকায় এ ধরনের সংবাদে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের জন্য পুনরায় টেন্ডার আহ্বান করা হবে। দ্রুত এটা করতে পারলে খুব বেশি দেরি হবে বলে আমরা মনে করি না। আশা করি, যথাসময়ে শিক্ষার্থী বই পাবে।’
ছাপায় এগিয়ে প্রাথমিকের বই, আটকা নবম-দশম
মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টমের বই নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও প্রাথমিকের সব শ্রেণির বইয়ের ক্রয়াদেশে অনুমোদন দিয়েছে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি। অনুমোদন মিলেছে মাদরাসার ইবতেদায়ি শ্রেণির বইয়েরও। এসব বই ছাপতে এখন ছাপাখানার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করছে এনসিটিবি। চুক্তির পর বই ছাপাতে ৭০ দিন সময় পাবে ছাপাখানাগুলো।
এদিকে, নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। মাধ্যমিক স্তরের তিন শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার বাতিল হওয়া নবম-দশমের বইয়েও ক্রয়াদেশ মিলবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে এনসিটিবি কর্মকর্তারা। এ বইয়ের টেন্ডার বাতিল হলে আরও সংকট বাড়বে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
পুনরায় টেন্ডারে পেছাবে বই ছাপা, শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে এপ্রিল!
এনসিটিবিকে পুনরায় টেন্ডার আহ্বানের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। চলতি মাসেও যদি পুনরায় টেন্ডার অহ্বান করা হয়, তাহলে আবেদন জমা নেওয়া, মূল্যায়ন, প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই, ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠানো এবং অনুমোদন, চুক্তিসহ নানান কাজ শেষ করতেই প্রায় তিনমাস লাগবে। আর চুক্তির পর বই ছাপাতে ছাপাখানার মালিকরা ৭০ দিন সময় পাবেন।
অর্থাৎ, পুনরায় টেন্ডারে খাতা-কলমে সময় লাগবে পাঁচমাস। বাস্তবে এর চেয়েও বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে। ফলে ষষ্ঠ-সপ্তম-অষ্টমের শিক্ষার্থীদের বই পেতে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। এতে জানুয়ারির পরিবর্তে শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে হবে এপ্রিলে। কারণ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত রোজা ও ঈদের ছুটি থাকবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জানুয়ারিতে শিক্ষাবর্ষ শুরু করলে পাঠদানের জন্য বেশি সময় পাওয়া যায়। তবে পাঠদান বা শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে শিক্ষার্থীদের হাতে অবশ্যই পাঠ্যবই পৌঁছানো জরুরি। এবার ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরু। রোজা ও ঈদের লম্বা ছুটি থাকবে। তার আগে শিক্ষার্থীরা বই হাতে পেলে বাড়িতেও পড়ার সুযোগ পাবে। আশা করি, এনসিটিবি জানুয়ারিতেই বই পৌঁছে দেবে।’
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এবার হাতে অনেক সময় নিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম। কোনো ত্রুটি বা পুনরায় টেন্ডার করলেও যাতে খুব বেশি পিছিয়ে না যায়, সেদিকে আমাদের নজর ছিল। সরকারও বই ছাপার কাজকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। পুনরায় টেন্ডার হলেও কাজ শেষ করতে দেরি হবে না। এবার যথাসময়ে শিক্ষার্থীরা বই পাবে।’
এএএইচ/এএসএ/এমএফএ/এএসএম