বঙ্গবন্ধুর খুনি-সাকা চৌধুরীসহ যাদের ফাঁসিতে ঝোলান জল্লাদ শাহজাহান

3 months ago 41

দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক ফাঁসি কার্যকর করার রেকর্ডধারী ‘জল্লাদ’ শাহজাহান ভূঁইয়া। কারা কর্তৃপক্ষের হিসাবে ২৬ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন তিনি। যদিও শাহজাহানের দাবি ছিল, তিনি ৬০ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। ফাঁসির এ তালিকায় আছে বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, এরশাদ শিকদারের মতো ব্যক্তি।

কারাগারের নথি অনুযায়ী, ২৬ জনের মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, চারজন যুদ্ধাপরাধী, খুলনার কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলা ভাইসহ দুজন জেএমবি সদস্য ও ১৪ জন অন্য আলোচিত মামলার আসামির ফাঁসি কার্যকর করেছেন শাহজাহান।

জানা যায়, শাহজাহান ভূঁইয়া একমাত্র জল্লাদ যিনি একরাতে দুই কারাগারে চার আসামির ফাঁসি কার্যকর করেছেন। তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করা জল্লাদদের আইডল মনে করা হয়।

যাদের ফাঁসিতে ঝোলান জল্লাদ শাহজাহান
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি- কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ, লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি- আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী এবং মীর কাসেম আলী।

বঙ্গবন্ধুর খুনি-সাকা চৌধুরীসহ যাদের ফাঁসিতে ঝোলান জল্লাদ শাহজাহান

আলোচিত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানের মৃত্যুদণ্ডও তিনিই কার্যকর করেন।

শাহজাহানের পরিচয়
পুরো নাম মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ। জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রাম। তার তিন বোন ও এক ভাই। বাবার নাম হাছেন আলী, মায়ের নাম মেহের। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। খাস হাওলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন পারলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।

সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিন বছর
ছোট থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড তাকে খুব আকর্ষণ করতো। বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খলাবোধ তার বেশি ভালো লাগতো। তাই মনেপ্রাণে সব সময় চাইতেন সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। বাবার কাছে একবার খবর পান সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়া হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করলে তিনি টিকে যান। পরে তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর বাড়ি চলে আসেন। চাকরি করবেন না বলে ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে সেনাবাহিনী থেকে চাকরি হারান।

নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ
মুক্তিযুদ্ধের পরের কথা। তখন তিনি তরতাজা তরুণ। এইচএসসি পাস করেছেন। মনের অজান্তে ভালো লেগে যায় কমিউনিস্ট পার্টি, যোগ দেন দলে। তার কার্যক্রমে খুশি হয়ে কেন্দ্র থেকে ডেকে পাঠানো হয়। সেসময় নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি রাজি হন। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব নেন।

অপরাধ জগতে প্রবেশের ইতিবৃত্ত
মানুষ হিসেবে শাহজাহানের বেশ সুনাম ছিল। পারতপক্ষে কারও উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। তবে প্রচণ্ড বন্ধু পাগল ছিলেন। একবার গ্রামে দুই বন্ধুসহ শাহজাহানের নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে বসা সালিশ কার্যক্রমে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই বদলে যান। ওইদিনের অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করার।

বঙ্গবন্ধুর খুনি-সাকা চৌধুরীসহ যাদের ফাঁসিতে ঝোলান জল্লাদ শাহজাহান

যেভাবে আটক হন
গ্রামের ওই ঘটনার পরে শাহজাহান তখন বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পর থেকে যে কোনো অপারেশনে (দলীয় গোপন কার্যক্রমে) তার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়, এটাই ছিল তার জীবনে সবশেষ অপারেশন। সেখানে কাজ শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। তবে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফিরছে।

মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে তা জানতে পারেন। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন, সেসময় তাকে আটক করে পুলিশ। এরপর থেকে তার বন্দিজীবন শুরু।

যেভাবে জল্লাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ
জীবনের সোনালি সময় তাকে কারাগারেই কাটাতে হবে- এমন ভাবনা থেকে চিন্তা করলেন জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে সাজা কিছুটা হলেও কমবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথমে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদ মনোনীত করে।

প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসিতে ঝোলান। একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ছয়জন সহযোগী থাকেন। এছাড়া একটি ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। শুধু ফাঁসির রায় কার্যকর নয়, কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন।

‘বাইরের জীবন এত কঠিন জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম’
চলতি বছরের ১ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে নিজের জেল পরবর্তী জীবনের অভিজ্ঞতা ও নানা প্রতারণার ঘটনা জানাতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন জল্লাদ শাহজাহান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কারাগারের বাইরের জীবন এত জটিল কেন? জীবন এত কঠিন হবে জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম।

জেল থেকে বের হয়ে নানাভাবে প্রতারিত হয়েছেন তিনি, হারিয়েছেন সর্বস্ব। সাথী আক্তার নামে ২৩ বছর বয়সী এক নারীকে বিয়ে করেও হয়েছেন প্রতারিত। স্ত্রী তার সব টাকা আত্মসাৎ করে উল্টো শাহজাহানের নামেই মামলা দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর খুনি-সাকা চৌধুরীসহ যাদের ফাঁসিতে ঝোলান জল্লাদ শাহজাহান

শাহজাহান বলেন, জেল থেকে বেরিয়ে দেখছি, এ সমাজে চলতে গেলে এত প্রতারণার মধ্যে পড়তে হচ্ছে আমাকে। আমি কল্পনা করতে পারিনি। বাইরের লোক সম্পর্কে আমার এমন ধারণা ছিল না, তারা এত নির্দয় হতে পারে আমার জানা ছিল না। যেখানেই যাচ্ছি প্রতারকদের খপ্পরে পড়ছি। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বিয়ে করে সেখানেও সর্বস্বান্ত হয়েছি।

কারাগার থেকে বেরিয়ে যা বলেছিলেন শাহজাহান
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শাহজাহান ভূঁইয়া কারামুক্ত হয়েই বলেছিলেন, প্রতিটি ফাঁসির আগেই আবেগ কাজ করেছে। এখানে তো আমার কিছু করার নেই। এ কাজ (ফাঁসি) কাউকে না কাউকে তো করতে হতো। এখন আমি চলে আসছি, অন্য কেউ করবে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে আমাকে এ কাজ করতে হয়েছে।

শাহজাহান বলেন, ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে এরশাদ শিকদার বলেছিলেন, তিনি কোনো অন্যায় করেননি, আর মুনীর একটি সিগারেট চেয়েছিলেন।

হত্যা ও অস্ত্র মামলায় তার ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল শাহজাহানের। ফাঁসি কার্যকর ও অন্যান্য কারণে তার সাজার মেয়াদ কমিয়ে করা হয় ৩২ বছর। দীর্ঘ ৩২ বছর পর মুক্ত আকাশের নিচে শ্বাস ফেলার সুযোগ পান জল্লাদ শাহজাহান। গত বছরের ১৮ জুন মুক্তি পান তিনি। আর চলতি বছরের ২৪ জুন তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

টিটি/এএসএ/জেআইএম

Read Entire Article