রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকট রয়েছে। প্রায় সাত মাস ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। এ সংকট কাটাতে অভিভাবকরা ভালো শিক্ষকদের পদায়ন ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের দাবিকে উপেক্ষা করে উল্টো অযোগ্য-অদক্ষ এবং অনৈতিক কাজে জড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে শাস্তিমূলক বদলি হওয়া শিক্ষকদের আবারও স্কুলটিতে ফেরানো হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরিতে টানা দেড় থেকে দুই যুগ চাকরি করেছেন।
অথচ ভোল পাল্টে তারা এখন নিজেদের বিএনপি-জামায়াতপন্থি বলে দাবি করছেন। তুলছেন বৈষম্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ। কেউবা তদবিরের জোরে পদায়ন নিয়ে রাজধানীর নামি এ স্কুলে ফিরছেন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। সম্প্রতি ১৬ সদস্যের অভিভাবকদের প্রতিনিধিদল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানান, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে শিক্ষক পদের সংখ্যা ৫৪টি। তার মধ্যে ১২টি শিক্ষক পদ শূন্য রয়েছে। ফলে বিষয়ভিত্তিক ক্লাসগুলো চালিয়ে নিতে শিক্ষকদের বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। তাছাড়া রাজধানীর নামি প্রতিষ্ঠানে যেমন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক প্রয়োজন, তা প্রতিষ্ঠানটিতে নেই। একই সঙ্গে সহকারী প্রধান শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী প্রধান শিক্ষক না থাকায় স্কুলে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।
‘ভালো’ শিক্ষক আউট, আসছেন অনৈতিক কাজে জড়িতরা!
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। স্কুলে ভালো শিক্ষক হিসেবে যারা পরিচিতি, তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা বদলির আবেদন না করলেও আবেদন করেছেন দেখিয়ে অন্য স্কুলে বদলি করা হচ্ছে। আর তাদের স্থলে আনা হচ্ছে এ স্কুলে অনৈতিক কাজে জড়ানোর দায়ে শাস্তিমূলক বদলি করা শিক্ষকদের। সম্প্রতি মাউশির ডিজিকে দেওয়া অভিযোগে বিষয়টি তুলে ধরেছেন অভিভাবকরা।
লিখিত অভিযোগ বলা হয়েছে, সম্প্রতি মো. সোলায়মান ও ইমারত হোসেনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের বদলি করানো হয়েছে। তারা দুজনই ইংরেজির শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করায় তাদের দক্ষতা ভালো। অথচ তাদের সরিয়ে সেখানে আনা হয়েছে সিকান্দার আলী নামে এক শিক্ষককে। তিনি সাধারণ বিএ ও বিএড ডিগ্রিধারী।
অভিযোগের তথ্যমতে, সিকান্দার আলী চাকরিতে যোগদানের পরপরই তদবির করে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে পদায়ন নেন। এরপর টানা ২২ বছর তিনি একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। ২০২১ সালে তার বিরুদ্ধে অভিভাবকরা অভিযোগ করলে তার সত্যতা পাওয়ায় তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তদবির করে ল্যাবরেটরি স্কুলে দীর্ঘ সময় চাকরি করলেও ৫ আগস্টের পর তিনি হঠাৎ নিজেকে জামায়াতপন্থি হিসেবে প্রচার শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি আবারও স্কুলটিতে পদায়ন বাগিয়ে নিয়েছেন।
অন্যদিকে, নতুন করে বদলি হয়ে ল্যাবরেটরি স্কুলে আসা আরেক শিক্ষক রাফি আহম্মেদের নৈতিক স্খলনজতি সমস্যা রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। লিখিত অভিযোগে রাফির ব্যাপারে অভিভাবকরা জানিয়েছেন, রাফি আহম্মেদ টানা ১৩ বছর ল্যাবরেটরি স্কুলে ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের তার কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করতেন। ২০১৪ সালে এক ছাত্রের মায়ের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে তাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হন।
এ নিয়ে ওই নারীর স্বামী মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেন। এ ঘটনায় রাফি আহম্মেদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ায় প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে থানায় ৩ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলা করেন রাফি। সেই মামলার তদন্তে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় রাফিকে শাস্তিমূলক ঢাকার বাইরে বদলি করে মাউশি। ৫ আগস্টের পর তিনি নিজেকে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী দাবি করে ল্যাবরেটরি স্কুলে পদায়ন বাগিয়ে নেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, রাফি আহম্মেদ একজন নারীলিপ্সু ও চরিত্রহীন শিক্ষক। তিনি এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ে করেছেন। তৃতীয় বিয়ের পর দ্বিতীয় স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। পরে চাকরি বাঁচাতে তৃতীয় স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন মর্মে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নোটিশ পাঠান। সেই নোটিশও ভুয়া প্রমাণিত হয়।
নবম শ্রেণির একজন ছাত্রের মা সিফাত সিদ্দিকা তন্নি। মাউশিতে অভিযোগ দেওয়া ১৬ জনের মধ্যে তিনিও একজন। সিফাত সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘যাদের বদলি করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা খুব ভালো ক্লাস নিতেন। আমার ছেলে তাদের খুব পছন্দ করতো। নতুন যিনি এসেছেন, তিনি ভালো ইংরেজি পড়াতে পারেন না বলে জেনেছি। আমরা তো চাই, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ভালো ভালো শিক্ষক থাকুক। আমাদের সন্তানরা যেন ভালোভাবে শিখতে-পড়তে পারে।’
সাফিয়া বানু নামে আরেকজন অভিভাবক বলেন, ‘শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্র ভালো হওয়াটা জরুরি। কিন্তু যাদের ব্যাপারে কথা উঠেছে, তাদের নিয়ে কোনো ভালো কথা শুনছি না। এজন্য আমরা মাউশিতে অভিযোগ করেছি। তাদের সরিয়ে যেন ভালো চরিত্রবান ও দক্ষ শিক্ষক আনা হয়।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক রাফি আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে আমার দুটি বউ (স্ত্রী) আছে। তাদের সঙ্গে আমি সংসার করছি। বাকি ঘটনাগুলো মিথ্যা। আমি ও সিকান্দার আলী স্যার বৈষম্যের শিকার। আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’ তবে সিকান্দার আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মোস্তফা শেখ বলেন, ‘শিক্ষক সংকট তো আছেই। সমস্যাও তো নানামুখি। এখানে অনেক জটিলতা। এসব নিয়ে আসলে অল্প সময়ে বা মোবাইল ফোনে কথা বলে শেষ করা যাবে না। বোঝানোও সম্ভব হবে না।’
জানতে চাইলে মাউশির মাধ্যমিক বিভাগের সহকারী পরিচালক এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিন পদ্ধতিতে বদলি করা হয়। শিক্ষকের আবেদন, জনস্বার্থে ও প্রশাসনিক কারণে। কেউ যদি আবেদন না করেন, তাহলে তাকে জনস্বার্থে ও প্রশাসনিক কারণে বদলি করা হয়ে থাকে। কিন্তু আবেদন না করলেও কাউকে বদলি করা এবং তাতে তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বদলি—এমনটা লেখার প্রশ্নই আসে না। হয়তো ভুলক্রমে এমনটা হতে পারে।’
শিক্ষকের একাধিক বিয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইনত একাধিক বিয়ে কোনো সমস্যা না হলেও শিক্ষক হিসেবে সামাজিকভাবে তার সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। নৈতিক স্খলন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এই শিক্ষকদের পদায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই আরও সতর্ক হতে হবে।
এএএইচ/এমকেআর/জিকেএস