বন্যার পর ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন ফেনীর কৃষকরা

2 weeks ago 12
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় লন্ডভন্ড হয়ে যায় ফেনী। ২০ আগস্ট দুপুর থেকে ফেনীতে বন্যা শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টার মাথায় তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা শুরুতে বন্যাকবলিত হলেও পরে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এ বন্যায় অনেক চাষি, খামারি, ব্যবসায়ী সবকিছু হারিয়ে পথে বসে যান। ভয়াবহ এ বন্যায় সরকারি হিসাবে ফেনীতে ২৯ জন প্রাণ হারান। ১১ লাখের বেশি মানুষ এবং ৯৫ শতাংশ এলাকা বন্যা দুর্গত হয়। দুই লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।  এ ছাড়া কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, ঘরবাড়িসহ সব খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয় ওই বন্যায়। জেলার ৮ হাজার ৯৫টি কাঁচাঘর, আড়াইশ আধাপাকা ঘর সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে প্রায় ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি সাধিত হয়। ৫৩ হাজার ৪৩৩টি কাঁচাঘর এবং ২ হাজার ৬৩২টি আধাপাকা ঘর ভেঙে পড়ে।   বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া ৩৪ হাজার ৭৭ হেক্টর জমির আবাদ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আবাদ করা ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজি, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার প্রায় আড়াই মাস শেষ হলেও রয়ে গেছে বন্যার ক্ষত চিহ্ন। এসব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছেন ফেনীর বাসিন্দারা, চেয়েছেন সরকারি সহায়তা। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, যতটা দরকার, ততটা সরকারি সহায়তা তারা এখনো পাচ্ছেন না।  সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বন্যার ক্ষত কাটিয়ে উঠতে জেলার প্রান্তিক চাষিরা মাঠে শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যদিও এখনো কিছু কিছু জমিতে পানি রয়ে গেছে, তবে উঁচু জমি ও বসত ভিটার আঙিনায় নানা ধরনের শীতকালীন আগাম সবজি চাষে ব্যস্ত রয়েছেন। এ ছাড়া অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ধারদেনা করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দ্রব্যসামগ্রী তুলছেন। গৃহহীন অনেক পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় গৃহ নির্মাণে কাজ করছেন। বন্যার ধকল কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন জেলার প্রান্তিক জনপদের বাসিন্দারা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনেকেই এগিয়ে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরলসভাবে কাজ করেছে। জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ছয় উপজেলায় কেবল কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৫২৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তার মধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন ক্ষেত ও ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ রয়েছে। এ ছাড়া ৩৪ হাজার ৭৭ হেক্টর জমির আবাদ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি আবাদও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বলছে অধিদপ্তর। এ ছাড়া আবাদ করা ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরোটাই, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষির পাশাপাশি বন্যায় নার্সারি ও বনায়নের ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৫ হাজার ৬৪৮ টাকার।  ফেনী জেলা কৃষি বিভাগ আরও জানায়, ফেনীতে চলতি শীত মৌসুমে ৫ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে ৮৪০ হেক্টর জমিতে শাক সবজির আবাদ হয়ে গেছে। বাকি জমিতে আগামী মাসগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। বিভাগ কৃষকদের পরামর্শসহ সব ধরনের সহায়তায় মাঠে কাজ করছে। এর মধ্যে বসতভিটার আঙিনায় শীতকালীন চাষাবাদে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য ২৩ হাজার কৃষককে প্রণোদনার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। যার তালিকা সম্পূর্ণ করা হয়েছে। এদের প্রত্যককে বিকাশের মাধ্যমে নগদ ১ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া মাঠে শীতকালীন সবজি চাষাবাদের জন্য ৪৩ হাজার কৃষকের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। যারা নগদ ১ হাজার টাকা ও সঙ্গে সার ও বীজ পাবেন। এ ছাড়া রবি ফসলের জন্য ১২ হাজার কৃষকের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে, যারা শুধু বীজ ও সার পাবেন। এখন কৃষি উপকরণ সংগ্রহের কাজ চলছে এগুলো হাতে পেলে দ্রুত বিলির কাজ শুরু হবে বলে জেলা কৃষি বিভাগ দৈনিক কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন।  ভয়াবহ এ বন্যায় জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতকৃত হিসাবে সর্বোচ্চ ক্ষতি নিরূপিত হয়েছে শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের। ওই খাতগুলোতে মোট ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে ১ হাজার ২০ কোটি ৭২ লাখ ১৪ হাজার ৩৯ টাকা। জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২ হাজার ১৬৪টি ভেড়া, ১১ হাজার ৪৮৭টি ছাগল, ৩০ হাজার ৬৫০টি গরু, ১৯৪টি মহিষ, ৫৭ লাখ ২১ হাজার ৩০১টি মুরগি এবং ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৭৭টি হাঁস বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। এ ছাড়াও ভেসে গেছে ৪ হাজার ৬৬৫ হেক্টর মাছের ঘের। সবমিলে বন্যায় প্রাণী ও মৎস্যে আনুমানিক ক্ষতি ৫৭৫ কোটি টাকা। বন্যার পর ফেনী সদর, পরশুরাম, সোনাগাজী ও ফুলগাজী উপজেলার ৭৯৩ জন ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষির মধ্যে অক্টোবর মাসে ৩ দশমিক ৮২২ মেট্রিক টন কার্প জাতীয় পোনামাছ বিতরণ করেছে জেলা মৎস্য বিভাগ।  এতে চাষিদের ৪ কেজি ও কোনো চাষিকে ১০ কেজি পোনাও দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। বাকি উপজেলায় পোনামাছ বিতরণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম। অন্যদিকে, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। বরাদ্দ এলে বিতরণ করা হবে। জেলার দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম মিন্টু কালবেলাকে জানান, বন্যায় আমার ২০ একর মাছের খামারে ভাসিয়ে নিয়ে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি করেছে। এ ছাড়া আমার গরুর খামার ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি।  ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের বাঘাইয়া গ্রামের ফখরুল ইসলাম বলেন, বন্যায় তার ছোট-বড় ২০টি মুরগির খামারে দেড় কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়। বন্যার পানি নামার পর ধারদেনা করে আটটি খামার চালু করতে পেরেছেন তিনি। খামারে বর্তমানে মুরগির লেয়ার বাচ্চা ও সোনালি বাচ্চা মিলিয়ে ১০ হাজার মুরগির বাচ্চা তোলা হয়েছে। এ ছাড়া সাড়ে ৪ হাজার লেয়ার পুলেট মুরগিও তুলেছেন এই খামারি। এখন কাজে গতি আনতে নগদ অর্থ দরকার হলেও ব্যাংক থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ ফখরুল ইসলামের। এজন্য তিনি সরকারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তা কামনা করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনী বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ফেনী জেলা শাখার সদস্য সচিব আরিফুর রহমান জানান, ফেনীতে বন্যা-পরবর্তী পোলট্রি ও মৎস্য খামারিদের সহযোগিতা প্রদানের জন্য মাননীয় অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমরা এখনো কোনো সহায়তা পাইনি।  এ ছাড়া বন্যায় গৃহহারা মানুষদের ঘর নির্মাণে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা এগিয়ে এসেছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গৃহহীনদের জন্য ৪০০ বান্ডেল টিন এবং নগদ ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোতে পরিবার প্রতি এক বান্ডেল টিন ও নগদ ৩ হাজার টাকা করে বিতরণ করেছেন ইউএনওরা। এ ছাড়া জেলার ৩ হাজার পরিবারের ঘর সংস্কারের জন্য ১০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে ইউএনডিপি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপ্সা দিয়েছে ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা জেলার অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণে এগিয়ে এসেছে।  সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ আরও অনেকে বন্যা-পরবর্তী সময়ে ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তারা সংস্কার কাজ ও পুনর্বাসনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।  এ বিষয়ে ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার কালবেলাকে জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বাড়িঘর সংস্কার ও পুনর্বাসনের জন্য ২০ হাজার বান্ডেল টিন এবং নগদ ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের কাছে। এ ছাড়া পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ১১০টি পরিবারকে সরকারি সহায়তায় ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। ফেনী জেলা প্রশাসন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় কাজ করে চলেছে। প্রতিটি সেক্টর ভিত্তিক ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। এজন্য বিভাগ ওয়ারি অর্থ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ এলে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হবে। 
Read Entire Article