বর্ধিত ৪১ শতাংশ মাশুল কার্যকর করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাত থেকে বন্দরের সব সেবা খাতে বর্ধিত এ মাশুল আদায় করা হচ্ছে। এতে দেশের উৎপাদনমুখী শিল্পখাত, ভোগ্যপণ্য, বাণিজ্যিক পণ্যসহ প্রায় সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ব্যবসায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। যার ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষও।
এ মাশুলের পরোক্ষ প্রভাব দেশের সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই মাশুলের বড় অংশ আদায় করা হবে শিপিং লাইন থেকে। কিন্তু তারা (শিপিং লাইন ব্যবসায়ীরা) এ বাড়তি খরচ যুক্ত করবেন পণ্য আমদানিকারক–রপ্তানিকারকের বিলে। আর আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক বাড়তি খরচ পণ্যের দামে যুক্ত করবেন। ফলে দেশে সরাসরি আমদানি পণ্য ও আমদানিনির্ভর কাঁচামালের কারণে বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বন্দরের এ মাশুল কিন্তু দিনশেষে ভোক্তার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। কারণ এটি বাড়লে কোম্পানিগুলোর অপারেটিং খরচ বাড়বে, যা পণ্যের দামে সমন্বয় করতে হবে।- টি কে গ্রুপের ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন ডিরেক্টর মোহাম্মদ শফিউল আতহার তসলিম
গত ১৪ সেপ্টেম্বর বন্দরের নতুন মাশুলের গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বন্দরের বিভিন্ন ধরনের সেবায় আগের তুলনায় গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে বন্দরের ৫২ সেবা খাতের মধ্যে ২৩টিতে সরাসরি নতুন মাশুল প্রযোজ্য হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে কনটেইনার পরিবহনের মাশুল। প্রতি ২০ ফুটের কনটেইনারের মাশুল ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা, যা আগে ছিল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা। অর্থাৎ, গড়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এভাবে আমদানি কনটেইনারে পাঁচ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানি কনটেইনারে তিন হাজার ৪৫ টাকা বেশি দিতে হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ মাশুল বাড়ানোর চাপ পড়বে উৎপাদনমুখী শিল্পখাত, ভোগ্যপণ্য ও বাণিজ্যিক পণ্যে। আবার রপ্তানিমুখী পণ্যে দুই দফায় বাড়তি মাশুল পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ, কিছু পণ্যের কাঁচামাল আমদানি ও সে কাঁচামাল থেকে তৈরি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও বর্ধিত মাশুল গুনতে হবে। এতে ব্যাহত হতে পারে দেশের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি।
এ সিদ্ধান্তে পোশাকখাত নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমনিতে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফের কারণে রপ্তানি বাণিজ্য টালমাটাল অবস্থায় আছে। ভারতের ওপর ট্যারিফ বেশি আরোপ করায় তারা ইউরোপের দিকে নজর বাড়াচ্ছে। সেখানে আমরা প্রতিযোগিতায় চাপে পড়ছি।- এইচকেসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী
এ বাড়তি মাশুলের কারণে তেল, চিনি, ডালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্য, সার, জ্বালানি তেল, নির্মণসামগ্রীসহ নানা ধরনের পণ্য ও পণ্যের কাঁচামাল আমদানি খরচ বাড়বে। তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যসহ জাহাজে পাঠানো প্রায় সব ধরনের রপ্তানিপণ্যের খরচ বাড়বে।
ভোগ্যপণ্য আমদানির খরচ বাড়বে
দেশে চাল ছাড়া তেল, চিনি, গমের মতো প্রধান প্রধান কয়েকটি ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর। আর এসব পণ্যের সিংহভাগ আসে স্থলপথে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে। ফলে এই মাশুল বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে আমদানি খাদ্যপণ্যের ওপর। বেশি ভুক্তভোগী হবে ভোক্তারা।
আরও পড়ুন
চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৬ সেবায় বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে ঝুঁকিতে ফেলবে বাড়তি বন্দর মাশুল
বন্দর মাশুল বাড়ায় দাম বাড়বে খাদ্যপণ্যের
বন্দরের বাড়তি মাশুল রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের ‘অশনিসংকেত’
দেশের অন্যতম খাদ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন ডিরেক্টর মোহাম্মদ শফিউল আতহার তসলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্দরের এ মাশুল কিন্তু দিনশেষে ভোক্তার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। কারণ এটি বাড়লে কোম্পানিগুলোর অপারেটিং খরচ বাড়বে, যা পণ্যের দামে সমন্বয় করতে হবে।’
আরেক ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘অস্বাভাবকি মাশুল বাড়ানোর ফলে ব্যবসার খরচ হঠাৎ করেই বাড়বে। আমদানি কমে যাবে অনেক প্রতিযোগিতামূলক পণ্যের। ফলে সাধারণত বন্দর যা বাড়িয়েছে, ভোক্তাদের তার চেয়ে বেশি হারে খরচ হবে।’
পোশাকের পরে সবচেয়ে বড় কারবার হচ্ছে এখন প্লাস্টিকে। আমরা বছরে দেড় মিলিয়ন টন প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করছি, যার প্রায় ৯৯ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে। আবার প্রতি বছর হাফ মিলিয়ন টন পণ্য রপ্তানি করছি। ফলে বন্দরের বর্ধিত মাশুল আমাদের খাতের বড় খরচ বাড়াবে।- বিপিজিএমইএ সভাপতি সামিম আহমেদ
পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেহেতু জ্বালানি তেল ও সারের মতো পণ্যগুলোর আমদানি ব্যয় বাড়বে, তাতে দেশে উৎপাদিত অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেও বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
রপ্তানিতে ‘অশনি সংকেত’
যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কে রপ্তানি বাণিজ্যে বাড়তি চাপের মধ্যে বন্দরের এ মাশুল রপ্তানিখাতেও বড় নেতিবাচক প্রভাব বলে মনে করছেন রপ্তানিমুখী ব্যবসায়ীরা। বন্দর দিয়ে রপ্তানিপণ্য সরাসরি কনটেইনারে বিদেশে যায়। ফলে কনটেইনারে মাশুল অতিরিক্ত বাড়ানোর চাপ পড়বে বাণিজ্যিক রপ্তানিপণ্যে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক এইচকেসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তে পোশাকখাত নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমনিতে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফের কারণে রপ্তানি বাণিজ্য টালমাটাল অবস্থায়। ভারতের ওপর ট্যারিফ বেশি আরোপ করায় তারা ইউরোপের দিকে নজর বাড়াচ্ছে। সেখানে আমরা প্রতিযোগিতায় চাপে পড়ছি। এর মধ্যে খরচ বাড়ায় আমাদের রপ্তানিখাত আরও ঝুঁকিতে পড়বে।’
মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহ-সভাপতি ও আরাফাত ফ্যাশনের কর্ণধার এ এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, ‘নতুন বর্ধিত মাশুল কার্যকর হলে ক্রেতারা পোশাক নেবে না। তারা ভিয়েতনাম ও ভারতে চলে যাবে।’
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বন্দর কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। এটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আমরা কখনো বন্দরে লোকসান দেখিনি। কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিক লাভ করেছে। তাতে এ মুহূর্তে গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, ভারত ও মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের ব্যবসার খরচ এমনিতেই বেশি। এটি দেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।’
বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি সামিম আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পোশাকের পরে সবচেয়ে বড় কারবার হচ্ছে এখন প্লাস্টিকে। আমরা বছরে দেড় মিলিয়ন টন প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করছি, যার প্রায় ৯৯ শতাংশ চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে। আবার প্রতি বছর হাফ মিলিয়ন টন পণ্য রপ্তানি করছি। ফলে বন্দরের বর্ধিত মাশুল আমাদের খাতের বড় খরচ বাড়াবে। একবার কাঁচামাল আমদানিতে বাড়তি খরচ ও পরে রপ্তানির জন্য দ্বিতীয় দফায় খরচ করতে হবে। এতে আমরা অন্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে বিশ্ববাজারে টিকতে পারবো না।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি খাতের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, চীন, ভারত ও কম্বোডিয়া নানাভাবে তাদের দেশে ব্যবসার খরচ কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। মাশুল কার্যকর হলে বাংলাদেশে কিছু পণ্যের রপ্তানি খরচ তিনগুণ বাড়বে। এটা সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বন্দরের নতুন ট্যারিফ কার্যকর হলে এ অঞ্চলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বন্দরে পরিণত হবে চট্টগ্রাম বন্দর।
বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দিতে নতুন মাশুল?
চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল কার্যকর হওয়ার আগে থেকেই বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দিতে নতুন মাশুল কার্যকর করা হচ্ছে বলে সমালোচনা রয়েছে।
বিপিজিএমইএ সভাপতি সামিম আহমেদ বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম বিদেশি অপারেটর এলে তাদের উন্নত লজিস্টিক ও প্রযুক্তি দিয়ে মাশুল কমাবে। কিন্তু এখন দেখছি, তাদের বাড়তি সুবিধা দিতে আগে থেকেই মাশুল বাড়িয়ে দেওয়া হলো।’
এদিকে গত রোববার চট্টগ্রামের র্যাডিসন ব্লু হোটেলে বন্দরে অস্বাভাবিক ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রতিবাদে ‘চট্টগ্রামের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীবৃন্দ’র ব্যানারে এক সভায় বিভিন্ন খাত ও সংগঠনের ব্যবসায়ীরারা বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দিতে নতুন মাশুল কার্যকর করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, বিদেশি অপারেটররা চায় ট্যারিফ বাড়িয়ে দেওয়া হোক। মাশুল বৃদ্ধির নেপথ্যে যারা আছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। বর্ধিত মাশুল স্থগিত রেখে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সভায় এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ‘মোংলা ও পায়রায় মাশুল বাড়ানো হয়নি, বাড়ানো হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। ডিপি ওয়ার্ল্ড, মায়ের্সক লাইনের (বন্দর পরিচালনা ও লজিস্টিকস কোম্পানি) পেছনে কারা, এজেন্ট কারা, অফিসে কারা যায়, আমাদের কাছে খবর আছে। বলে দিলে তখন লজ্জা পাবেন। আপনারা যাকে ইচ্ছা তাকে টার্মিনাল দিয়ে দেবেন, সেটা হবে না। পতেঙ্গা টার্মিনাল যারা ছেড়ে দিয়েছে, তাদের পরিণতি আমরা দেখেছি।’
এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/জিকেএস