বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনা কালো অধ্যায়: আদালত

2 months ago 31

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসের ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে কালো অধ্যায় বলে মন্তব্য করেছেন আদালত।

বুধবার (১০ জুলাই) গার্ডার ধসের ঘটনায় ১৩ জনের প্রাণহানির মামলার রায়ে পর্যবেক্ষণে চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞা এ মন্তব্য করেন।

আদালত বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা যাই বলি না কেন সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রমাণিত। এত বিশাল আকারের কর্মযজ্ঞের মধ্যে তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে ১১ জন মানুষ মারা যাওয়া এবং বহু মানুষ আহত হওয়ার এ ঘটনা বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে অন্যতম কালো অধ্যায়।’

যে কোনো দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক দোষারোপ উদ্বেগজনক মন্তব্য করে আদালত বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতার অভাব, নির্মাণকারী ঠিকাদার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয় না থাকা, ফ্লাইওভার নির্মাণের মতো এত বিশাল কর্মযজ্ঞে ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং দুর্ঘটনার পর ফ্লাইওভার নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক দোষারোপ ইত্যাদি বিষয় অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাশাপাশি উদ্ভুত যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে।’

এ দুর্ঘটনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দায় রয়েছে উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘আসামিপক্ষের সাক্ষ্য, পত্রিকার কপি এবং একজনের সাক্ষ্য দ্বারা দেখা যায়, একজন ভিকটিম চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। সুতরাং সিডিএ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাধ্যমে কর্ণধার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে।’

আদালত আরও বলেছেন, ‘প্রসিকিউশনের সব সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনায়, এই মামলার দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনসহ মোট তিনটি তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণিত, মামলার এক থেকে ৭ নম্বর আসামি দুর্ঘটনার সময় সবাই মীর আখতার-পারিসা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। অতএব ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হিসেবে আসামিরা এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।’

আরও পড়ুন

আদালত বলেন, ‘বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত এ দুর্ঘটনার দায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে সব কর্মচারীর। তারা যে পদেই থাকুক না কেন। আসামিরা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংযুক্ত যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী থাকবে। এ দায় আসামিদের ব্যক্তিগত নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক দায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের দায় হওয়ায় আসামিরাও সমানভাবে দায়ী। অবহেলাজনিত অপরাধের জন্য আসামিদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকাটা আবশ্যিক নয় বলে আদালত মনে করে।’

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘প্রতিষ্ঠানের সাজা ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাজা ভোগের মাধ্যমেই কার্যকর হবে। তা নাহলে ভবিষ্যতে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা হুমকির মুখে পড়বে। একইসাথে দুর্ঘটনার শিকার এই নিম্নবিত্ত মানুষগুলোর পরিবারের অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে না।’

বুধবার (১০ জুলাই) দুপুর সোয়া ১২টায় আদালত রায় ঘোষণা শুরু করেন। রায়ে আদালত একযুগ আগে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার ধসে ১৩ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পৃথক দুই ধারায় মোট সাত বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। দায়িত্ব পালনে গাফিলতির মাধ্যমে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের আট কর্মকর্তাকে এ সাজা দেওয়া হয়।

দণ্ডিতরা হলেন—ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন প্রকল্প ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনজুরুল ইসলাম, প্রকল্প প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, আমিনুর রহমান, আব্দুল হাই, মো. মোশাররফ হোসেন রিয়াজ, মান নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী শাহজান আলী ও রফিকুল ইসলাম।

রায় ঘোষণার সময় জামিনে থাকা আট আসামির প্রত্যেকে আদালতে হাজির ছিলেন। পরে আদালতের নির্দেশে সাজামূলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে ১৩ জন নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ করছিল। তখন সিডিএর চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য আবদুচ ছালাম।

এ ঘটনার পর ২৬ নভেম্বর নগরের চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। মামলা করেছিলেন চান্দগাঁও থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ। মামলায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল।

তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) এস এম শহীদুল ইসলাম আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে সিডিএর তিন কর্মকর্তা, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তিনজন এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মতিনসহ ১২ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়।

যাদের নাম বাদ দেওয়া হয় তারা হলেন- প্রকল্প পরিচালক এ এ এম হাবিবুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, এম এ মতিন, তানজিব হোসেন, সালাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, হোসাইন আহমেদ, শাহ জাহান, আবদুল হান্নান, আবছার হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান, বাবুল কুমার বিশ্বাস, অরুণ কুমার বিশ্বাস, আবদুল খালেক মিয়া, বায়েজীদ মীর কামাল, মেজবাহুল কবির, সাইদুর রহমান, সোহেল হাছান, তৌহিদুর রহমান ও তারেক মাহমুদ।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন সরকারি কৌঁসুলি ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী পিপির মতামত নেননি তদন্ত কর্মকর্তা। এমনকি অভিযোগপত্রে কোনো ত্রুটি আছে কি না, আদালতে উপস্থাপনের আগে খতিয়ে দেখেনি পুলিশের প্রসিকিউশন শাখাও। ফলে অনাপত্তি দেওয়ার সুযোগ ছিল না।

তিনি বলেন, মহানগর হাকিম আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে বিচারের জন্য পাঠান মহানগর দায়রা জজ আদালতে। দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র পাঠানো হলে মূল হোতাদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নজরে আসে। পরে অধিকতর তদন্তের আবেদন করা হলেও খারিজ করে দেন আদালত।

এএজেড/এমআরএম/এএসএম

Read Entire Article