বাংলাদেশ আজ রাজনীতির ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত
ঘূর্ণিঝড় কী, আমরা সবাই জানি। এটি হঠাৎ ঘটে না। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রের গভীরে তাপ জমতে জমতে একসময় তা বিধ্বংসী রূপ নেয়। নির্দিষ্ট পরিস্থিতি তৈরি না হলে ঘূর্ণিঝড় হয় না। আর যখন পূর্বাভাস উপেক্ষা করা হয়, তখন ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। বিপরীতে সময়মতো সতর্কতা নিলে প্রাণ বাঁচে, সম্পদ রক্ষা পায়, রাষ্ট্র টিকে যায়। আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনেকটা সেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো। এটি আকস্মিক নয়। বছরের পর বছর অবিশ্বাস, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, দলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা এবং ভিন্নমত দমনের ফলে এই ঘূর্ণিঝড়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি এই সংকেতগুলো পড়তে পারছি, নাকি পড়েও উপেক্ষা করছি। বর্তমান বাস্তবতায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো তথ্যের চেয়ে গুজব, বিশ্লেষণের চেয়ে উত্তেজনা এবং দায়িত্বের চেয়ে দোষারোপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভালো মন্দ যাচাই না করেই নানা মতামত মানুষের মনে ভীতি তৈরি করছে। এর ফল হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে এবং মানুষের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। এটি কোনো দলীয় সমস্যা নয়। এটি রাষ্ট্রের সংকট। এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত
ঘূর্ণিঝড় কী, আমরা সবাই জানি। এটি হঠাৎ ঘটে না। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রের গভীরে তাপ জমতে জমতে একসময় তা বিধ্বংসী রূপ নেয়। নির্দিষ্ট পরিস্থিতি তৈরি না হলে ঘূর্ণিঝড় হয় না। আর যখন পূর্বাভাস উপেক্ষা করা হয়, তখন ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। বিপরীতে সময়মতো সতর্কতা নিলে প্রাণ বাঁচে, সম্পদ রক্ষা পায়, রাষ্ট্র টিকে যায়।
আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অনেকটা সেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো। এটি আকস্মিক নয়। বছরের পর বছর অবিশ্বাস, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, দলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা এবং ভিন্নমত দমনের ফলে এই ঘূর্ণিঝড়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি এই সংকেতগুলো পড়তে পারছি, নাকি পড়েও উপেক্ষা করছি।
বর্তমান বাস্তবতায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো তথ্যের চেয়ে গুজব, বিশ্লেষণের চেয়ে উত্তেজনা এবং দায়িত্বের চেয়ে দোষারোপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভালো মন্দ যাচাই না করেই নানা মতামত মানুষের মনে ভীতি তৈরি করছে। এর ফল হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে এবং মানুষের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। এটি কোনো দলীয় সমস্যা নয়। এটি রাষ্ট্রের সংকট।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাজ শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা নয়, বরং আস্থা পুনর্গঠন। প্রশ্ন হলো তারা কি সেই আস্থার ভাষায় কথা বলছে। নাকি আমরা শুনছি এক কথা, দেখছি আরেক বাস্তবতা। সরকার যদি স্পষ্ট ও সময়োপযোগী রাজনৈতিক সতর্কতা না দেয়, তাহলে এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি বাড়বেই। আবার সঠিক সিদ্ধান্ত এবং স্বচ্ছ আচরণ থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াও সম্ভব।
দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে বিএনপির ক্ষেত্রে। এখানে দোষারোপ নয়, বরং বোঝার চেষ্টা জরুরি। তারা কি এই সংকটে একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্রিক ভূমিকা রাখতে পারছে। ইনকিলাব মঞ্চের মতো সম্মেলনগুলোতে সকল রাজনৈতিক শক্তির বাস্তব অংশগ্রহণ কতটা ছিল, সেটিও প্রশ্নের বাইরে নয়। নামমাত্র উপস্থিতি আর কার্যকর অংশগ্রহণ এক নয়। সংবাদপত্রের পাঠক সেটি বুঝতে পারছে।
ড. ইউনূসের মন্তব্য যদি সত্যিই সর্বজনীন সমর্থন পায়, তাহলে সেটিই তো জাতির ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে কি আমরা সেই ঐক্য দেখছি। নাকি ব্যক্তি ও দলের স্বার্থ জাতির ওপর প্রাধান্য পাচ্ছে। আমরা শুনেছি বহুবার বলা হয়েছে ব্যক্তির আগে দল, দলের আগে দেশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে দেশের আগে দল, দলের আগে ব্যক্তি। এই দ্বৈততা শুধু জনগণই দেখছে না, দেখছে দেশি বিদেশি সব পর্যবেক্ষক।
এখানেই আসে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বাস্তবতাকে বাস্তবতার চোখে দেখতে হবে। ভারত আমাদের প্রতিবেশী। কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা জরুরি। কিন্তু বন্ধুত্বের ধারণা যদি একপাক্ষিক হয়, তাহলে সেটি রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। ভারতের ভেতরেও বহু অঞ্চল রয়েছে যারা নিজেদের অধিকারের প্রশ্ন তুলছে। তারা লক্ষ্য করছে বাংলাদেশ কীভাবে দাঁড়াচ্ছে বা হোঁচট খাচ্ছে। এই বাস্তবতায় ভারত কখনোই চাইবে না বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে উদাহরণ হয়ে উঠুক। এটি কঠিন সত্য, কিন্তু অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
বারবার নিজেদের বোঝানো যে ভারত নিঃশর্ত বন্ধু, সেটিই এই রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম মূল কারণ। বন্ধু ও স্বার্থ এক জিনিস নয়। রাষ্ট্র যদি এই পার্থক্য না বোঝে, তাহলে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। তখন সে হয় স্বৈরশাসনের পথে হাঁটে, নয়তো অন্যের ছায়ায় বাঁচতে অভ্যস্ত হয়।
এই লেখায় ঘূর্ণিঝড় কোনো আবহাওয়ার ঘটনা নয়। এটি একটি সতর্ক সংকেত। প্রশ্ন হলো আমরা কি এবার পূর্বাভাস শুনব। নাকি আবারও দেরি করে বুঝব যে ক্ষতি হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত আজ নিতে হবে। কারণ রাজনীতির ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু সরকার বা দল নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো জাতি।
বাংলাদেশকে স্বাধীন ও নিরাপদ রাখতে হলে আমাদের আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু তা হবে রাষ্ট্রের স্বার্থে, কূটনৈতিক ভারসাম্যের ভিত্তিতে। কোনো ব্যক্তি বা দল যদি মনে করে ভারতকে খুশি করে ক্ষমতা ধরে রাখাই রাজনীতি, তাহলে সে ভুল করছে। সেই পথে গেলে শেখ হাসিনার শাসনের পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছুই হবে না।
বাংলাদেশ কোনো দলের সম্পত্তি নয়, কোনো প্রতিবেশীর পরীক্ষাগারও নয়। এই দেশ টিকে থাকবে তখনই, যখন আমরা দল নয় দেশকে আগে রাখব, ব্যক্তি নয় জনগণকে প্রাধান্য দেব। এখন প্রশ্ন একটাই, আমরা কি নিজের পায়ে দাঁড়াব, নাকি আবারও অন্যের ছায়ায় নিরাপত্তা খুঁজব। সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে, কারণ এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইতিহাস কোনো অজুহাত গ্রহণ করবে না।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]
এমআরএম/এএসএম
What's Your Reaction?