সানাউল্লাহ সাগর
যদি কোনো কিছুকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে দেখি; তখন প্রথম প্রশ্নই আসে পেশাদারত্ব নিয়ে। যদি সেটা ব্যবসা বা আয়ের মাধ্যম হয়, তাহলে ভোক্তা বা ক্রেতাদের ব্যবসার সাথে যুক্ত কর্তাব্যক্তিদের পেশাদারত্ব প্রত্যাশা করবেন—এটাই স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে—বাংলাদেশে আসলে প্রকাশনাকে কি ব্যবসা বলা যায়? আমি এতে হ্যাঁ-ই বলবো। তবে এটি ঠিক যে, প্রকাশনার সাথে যুক্ত সবাই হয়তো ব্যবসা করতে পারছেন না। পারছেন না এই প্রসঙ্গে আবার এটিও প্রশ্ন আসতে পারে যে, তারা কি ব্যবসা করতে চাচ্ছেন? যদি চান তাহলে কোনো ব্যবসা শুরুর আগে যেসব প্রস্তুতি লাগে—প্রকাশনায় আসার আগে বাংলাদেশে কি তেমন প্রস্তুতি সবার থাকে? না, থাকে না। আর যদি না-ই থাকে, তাহলে সেটি থেকে ব্যবসা প্রত্যাশা করাও কি ভুল নয়? অবশ্যই ভুল। পরিকল্পনা, ইভেস্টমেন্ট ও দক্ষ লোকবল যদি না থাকে, তাহলে সেটি থেকে তার যেমন প্রত্যাশা করা উচিত নয়; তেমন ভোক্তাদেরও তার কাছ থেকে তেমন কিছু পাওয়ার নেই।
বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে, তার প্রায় আশি ভাগেরই এই মূল তিনটি পয়েন্টে দুর্বলতা আছে। যেন ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। আর এই ঢাল তলোয়ারহীন যুদ্ধে নামার অপেক্ষায় থাকা কিংবা যুদ্ধে নেমে যাওয়ার সংখ্যাই যেখানে বেশি; সেখানে পেশাদারত্ব প্রত্যাশা করাও ভুল। আর প্রস্তুতি না থাকার কারণেই এই আশি ভাগ ব্যবসাহীন প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারছে না। কেউ কেউ বলবেন, তারা তো দিব্যি টিকে আছে! আর ব্যবসা না করতে পারলে টিকে থাকে কিভাবে? হুম তারা টিকে আছে সেটা ঠিক, আবার ব্যবসা করছে সেটাও ঠিক। তবে সে ব্যবসাটা বই বিক্রি করে না। সৌখিন লেখকদের কাছ থেকে নগদ অর্থ নিয়ে বই ছাপিয়ে। আর টাকা নিয়ে এসব বই ছাপানোর পর তাদের কোনো দায়বোধ থাকে না।
এ প্রসঙ্গে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি তার কোনো একটি লেখায় লিখেছেন, ‘আমার কাছে এক লোক তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে সরকারি চাকরির জন্য। সে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। আমি বললাম কৃষি কাজ করতে বলো। সে পড়ালেখা করেছে সেটা জানালো। আমি বললাম তাহলে তাকে মন্ত্রী করে দেও!’ বর্তমান প্রকাশনাও যেন এমন। যার কোনো কাজ করার সুযোগ নেই, মনে করে সে যেন অনায়াসে প্রকাশনা শুরু করতে পারে! আর ফলাফল আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। মানহীন বই। আর অসম্পাদিত বইয়ে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে মেলার মাঠ!
সম্প্রতি বইয়ের দাম রাখা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। বইয়ের দাম তুলনামূলকভাবে গত কয়েক বছরের চেয়ে এ বছর আরও বেড়েছে। তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সব কিছুর দামও তো বেড়েছে। সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—বইয়ের দাম নির্ধারণ আমরা কীভাবে করি? সাধারণত বইয়ের দাম নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা শুধু প্রিন্টিং খরচকেই বিবেচনায় রাখি। কন্টেন্টকে বিবেচনায় রাখি না। সম্পাদনা, প্রুফ রিডিং খরচ বিবেচনায় রাখি না। বইয়ের দামে প্রিন্টিং খরচের সাথে কন্টেন্টেরও একটা মূল্য যোগ করা উচিত।
আরও পড়ুন
বইয়ের দাম বাড়ছে, তা নিয়ে আমার খুব আপত্তি নেই। কারণ এখন এমন একটা সময়; যখন এক কাপ কফি খেতে ৮০-১২০ টাকা লাগে। এক বেলা খেতে ২০০-৩৫০ টাকা লাগে। সেখানে ৩০০-৪০০ টাকা একটা বইয়ের দাম হতেই পারে। তবে আমি চাই কন্টেন্ট বিচারে বইয়ের দাম নির্ধারণ করা হোক। যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে, সে সংগ্রহ করবে। আর ক্রেতার কাছে ২০%-২৫% ছাড় দিয়ে বই বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে। সব পণ্যই এমআরপিতে বিক্রি হয়। তাহলে বই কেন ২০-২৫% ছাড়ে বিক্রি করতে হবে?
অনেকেই বলেন, এরকম দাম রাখা প্রকাশকদের একটা ষড়যন্ত্র। গরিবরা যাতে বই কিনতে না পারে তার জন্য প্রকাশকরা এটা করছেন। সত্যি বলতে, যার দরকার নেই সে কিনবে না। ধনী-গরিব বলে এখানে কোনো ব্যাপার নেই। যার যেটা দরকার সে সেটা সংগ্রহ করবেই। আর যেটা বলেছি সেটা অযৌক্তিক কিছু বলিনি। কম টাকায় বই কিনতে চাইলে আমরা মানহীন বই পাবো। মানসম্মত কন্টেন্ট পেতে হলে তার মূল্য তো যথাযথ পরিশোধ করতে হবে।
যেটা নিয়ে কথা বলা দরকার, সেটা নিয়ে আমরা কেউ কথা বলি না। এটাই আমাদের সামগ্রিক দুরাবস্থার কারণ। লেখকদের বইয়ের রয়্যালিটি নিয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত। এটি তাদের অধিকার। অথচ সেটি নিয়ে আমরা তেমন কেউ কথা বলছি না। আবার এটিও সত্য কথা—বইয়ের দাম কম রাখতে বাধ্য হলে প্রকাশক লেখককে যথাযথ সম্মানি দেবেন কিভাবে? ঠকবে তো সেই লেখকই।
তবে আমাদের দেশে বইয়ের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াটা একটু গোলমেলে। যেমন এখানে বইয়ের দাম রাখা হয় না, শুধু কাগজের দাম বা মুদ্রণ খরচ রাখা হয়। কিন্তু একটি বইয়ের মূল্য নির্ধারণে লেখকের সম্মানি থেকে শুরু করে সম্পাদনা খরচ, প্রমোশন বাজেট ও প্রকাশকের ব্যবসা রাখা উচিত। না হলে লেখক সম্মানি পাবেন না। বই সম্পাদনা হবে না। পাঠকও ভালো মানের বই পাবেন না। এসব বিষয় অনুসরণ করে বলেই বিদেশি মূল প্রিন্টের বইয়ের দাম আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আর আমরা শুধু কাগজের দামে বই কিনতে কিনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সে কারণে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প পেশাদারত্বের জায়গা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। লেখকরাও পেশাদার মনোভাব প্রকাশ করতে পারছেন না।
মোট কথা, শিক্ষিত ও সচেতন পাঠক সমাজ, শিক্ষিত সম্পাদক ও পেশাদার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের দরকার। তাহলে আস্তে আস্তে আমাদের মনোভাবেরও পরিবর্তন হবে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পও সঠিক পথে এগিয়ে যাবে।
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।
এসইউ/এমএস