শাহানাজ শিউলী
বর্ষা প্রকৃতির সজীবতা ফিরিয়ে আনে। এর রূপ, রস, সৌন্দার্যের আহ্বানে সবুজ হয়ে ওঠে প্রকৃতির রূপ। রৌদ্রদগ্ধ তৃষাতুর ধরণীকে ভরিয়ে দেয় সুগন্ধি শ্যামল সমারোহ। সবুজ প্রকৃতি প্রাণ খুলে স্নান করতে থাকে বৃষ্টিতে। তার সঙ্গে মিতালী করে বাংলার নৈসর্গিক ছবি, গাছের ফুল, ফসলের মাঠ। নদীর কলতান যেন মায়াবীর এক স্বপ্নলোকের ইন্দ্রজাল রচনা করে দেয়। যেন চিরন্তন বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ মেলে। তার কোলে ঘেসে কালো মেঘের দাপাদাপি। অতল দিঘি কালো জলের শীতল স্পর্শ আনন্দ দুয়ার খুলে দেয়। ফোঁটা ফোঁটা জলরাশিতে হাসেরা খেলা করে। হিজল ডালে মাছরাঙ্গা মাছের তপস্যায় বসে থাকে।
আষাঢ়ের পথ ধরেই বর্ষার আগমন। মেঘের ভরা যৌবন কানায় কানায় ভরে দেয় বৃষ্টির পশলা। মেঘের গভীর নাদ আকাশের বিজলীতে জেগে ওঠে বিচিত্র অনুভূতি। প্রকৃতি স্বতন্ত্র বৈচিত্র্য স্বপ্নীল হয়ে ওঠে। ধরণীর বুকেও জেগে ওঠে অব্যক্তধ্বনির কুঞ্জ। প্রকৃতির শিরায় উপশিরায় দুলে ওঠে বর্ষার নাচন। তার সজল কালো পানিতে স্নান করে বৃক্ষরা সেজেগুজে প্রহর গুণে কার যেন অপেক্ষায়। বনে-বাগানে, মাঠে -ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, চারিদিকে বর্ষার শিহরণ। প্রাণের চাঞ্চল্য মনও আনন্দে উদ্বেল।
বৃক্ষরাজি হেসে ওঠে সবুজের মাঝে। রিমঝিম শব্দে নৃত্য করে। অপরূপা হয়ে ওঠে প্রকৃতি কন্যা। কখনো হালকা মেঘ, কখনো কালো ভারী মেঘের বর্ষণ, টিনের চালে খই ভাজতে থাকে। পাল তুলে ভেসে যায় নৌকা। মাঝে মাঝে চলে মেঘ বৃষ্টির রৌদ্রুর খেলা। মন উদাস হয়ে যায় বাঁধভাঙা ঢেউয়ে। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীর গভীর মিতালী চলে। প্রেয়সীকে কাছে পেয়ে আনন্দে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দে গান গাইতে থাকে ব্যাঙ। চারিদিকে থৈ থৈ পানি। বর্ষার সৌন্দর্য নিয়ে যায় এক অচিনপুরে। মনে হয় কোন এক নিপুণ চিত্রকর তার সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উজাড় করে পরম যত্নে নিজ হাতে অংকন করেছেন বর্ষার মনোলোভা সৌন্দর্য।
বর্ষায় ছেলে-মেয়েদের এক অপরূপ বাঁধভাঙা আনন্দ। কখনো ফুটবল, কখনো কাঁদামাটিতে পিচ্ছিল খাওয়া, কখনো কাবাডি, কখনো হাডুডু খেলার মহড়া চলে। এছাড়া বড়দের মাছ ধরা এক আনন্দের হিড়িক পড়ে যায়। তার সঙ্গে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা গামছায় ছেকে ছেকে মাছ ওঠায়। এক বাঁধ ভাঙা সুখ অনুভূতি তাদের মনকে চাঞ্চল্য করে তোলে। চারিদিকে তারার মত শাপলা ফোটে। কেউ রান্না করে খাই কেউবা শাপলার মালা বানিয়ে গলায় পরে কানে ঝোলায়। প্রকৃতি কন্যা প্রকৃতির সাজে অপরূপ হয়ে ওঠে। বর্ষায় কলার ভেলায় ভেসে চলা এক অবিরামানন্দ ছুঁয়ে যায় মন। তার সঙ্গে মিশে থাকে মায়ের মমতা মাখা হাতের খিচুড়ি।
আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাসের আনন্দের মিলনে আসে বর্ষা। বর্ষায় নদ-নদী, পুকুর -জলাশয়, নব আনন্দে জেগে ওঠে। টিনের উপর টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনে মন মাতোয়ারা হয়ে যায়। সুখ -দুঃখের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় অধীর হয়ে ওঠে বর্ষার মায়ায়। নদী সাগরের উচ্ছল ঢেউ নিয়ে যায় এক অচিনপুরিতে। সাগর আর আকাশের একাকারে নব প্রেমে উদ্ভাসিত হয়ে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয় চারিদিক। সেই সৌন্দর্য হৃদয়ের তন্ত্রগুলোতে যেন সুরে বেজে ওঠে বুকের গভীরে। সেই সুরে নেচে যায় ময়ূরপঙ্খী তার সাত রঙের পেখম খুলে মনের আনন্দে।
আবির রাঙা পূরবি ম্লান হয়ে যায় কালো সাদার দুধেল মেঘে। পশ্চিমাকাশ তার গায়ের সিঁদুর ধুয়ে রাঙিয়ে তোলে মাটি। জীবন আর প্রকৃতি স্থবির হয়ে যায় সাঝের মায়ায়। আলপনার শীর্ষদেশ বিলীন হয়ে যায় মায়ের বর্ষাভেজা আঁচলের তলায়। প্রকৃতি বারবার ভেজা প্রেমে আপ্লুত হয়। মায়ার চাহনিতে সৌন্দর্য ঝরে ঝরে রূপের পসরা সাজায়। বনরাজির অধরে বর্ষা এঁকে দেয় ভেজা সোহাগী চুম্বন। পাতাগুলো গেয়ে ওঠে ‘এইতো ভালো বর্ষার নাচন পাতায় পাতায়।’
বর্ষায় হাতছানি দেয় দুরের দৃশ্যাবলি। পাখিরা চরাভূমিতে গোসল করে ফিরে আসে বাসায়। টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়া শব্দে বুকের উড়ন্ত মিছিল যেন ঘরে ফেরার এক অনাবিল প্রশান্তি। বাঁশবনে শালিকরা খেলা করে বৃষ্টিতে ভিজে। বন-বাদাড়ে, পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে, নদী-নালায় সৌন্দর্যের উচ্ছলতা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক। তারার মত শাপলা ফোটে নাচতে থাকে পানির উপর। গ্রামের শ্যামল প্রকৃতি ডুব দেয় বর্ষায়।
বর্ষার নয়া পানিতে মাছেরা স্বাধীনভাবে খেলতে থাকে। টেংরা, পুঁটি, শিং, টাকি, মাগুর, রুই, কাতলা, শোল মনের আনন্দে ছোটাছুটি করে দিক-বিদিক। নতুন পানিতে পুঁটি মাছেরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। লাল বেনারসির আঁচলখানি বুকে জড়িয়ে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায় এ পাড়ায় ও পাড়ায়। ওদের সঙ্গে আনন্দে যোগ দেয় ঝিয়া, চিংড়ি। চিংড়িরা নাচতে থেকে কুলে এসে। বিলিয়ে দেই তাদের বিলাসী সুখ। কলার ভেলায় ভেসে বেড়ায় গ্রামের ছেলেমেয়েরা। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় মাছ ধরে আর মনের সুখে গান গাইতে থাকে মাঝি।
রিনিঝিনি শব্দে, ঝুমুর ঝুমুর তালে তালে বর্ষা অহর্নিশ ঝরে পড়ে বাংলার উর্বর ভূমিতে। তার বাহারি রংয়ের সুগন্ধি ফুলের সমারোহে আমাদের মনকে করে তোলে বিহোমিত। মাটির সোদা গন্ধে মন আকুল করে তোলে শাপলা, কেয়া, বকুল, জারুল, করবি, কলাবতী, কামিনী, জুঁই, কলমী। নববধূর মত ভেজা চুল এলিয়ে দেই কদম। তার চুলের সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক। পল্লীবধূ পালতোলা নৌকায় বাপের বাড়ি যাই ঘোমটা টেনে। বাতাসের দোলায় ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে হেলে-দুলে চলে নদীর বুকে। আকাশের বুকে ভেসে বেড়ায় কালো মেঘের ভেলা। রুক্ষ বাতি বৃষ্টিতে ভিজে রসসিক্ত হয়ে ওঠে।
চারিদিকে ধানক্ষেত আর তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস এক অনন্য অনুভূতি এনে দেয়। ঘরের বারান্দায় বসে গরম চা আর মুড়ির সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি দেখা এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের পালক হাতছানি দেয় প্রিয়জনের সাথী হওযার। তারই ভেজা ভেজা স্পর্শ এক অন্যরকম শিহরণ জাগায়।
ধানের ক্ষেতের বুকে ঢেউ লেগে জেগে ওঠে এক নতুন প্রাণ। ধান ক্ষেতের সঙ্গে মিতালী করে সবুজ ঘাস। বর্ষার মনোমুগ্ধকর মাদকতায় নেচে ওঠে স্বপ্ন তরী হাওড়-বাওড়, বিলে-ঝিলের জলে দিগন্ত বিস্তৃত জলাশয় শুভ্র হাসির সুমধুর স্নিগ্ধতায় হেসে ওঠে। সব আবর্জনা ধুঁয়ে মুছে নিয়ে যায় তার আপন মহিমায়। তার ভরা যৌবন উপছে পড়ে ফসলের মাঠে। ফুল-ফলের ঘ্রাণ আর পাখির কলকাকলি গ্রামের অন্তঃপুরে আমন্ত্রণ জানায়। পথের দু'ধারে তরুশাখা পেলব বাহুতে জড়াজড়ি করে। কচুর পাতার টলোমলো পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। মমতার পরশ দিয়ে ভিজিয়ে দেয় মাটির সারা অঙ্গে। বুঝিয়ে দেয় ক্ষণস্থায়ী জীবনের মূল্য।
বর্ষায় মন ভোলানো খাবারে মন আরও লোভাতুর হয়ে ওঠে। অলস সময় কাটে নানা রকম পিঠা, পায়েস, মজাদার খাবার তৈরির মাধ্যমে। কখনো নকশি কাঁথায় গ্রাম বাংলার মা, বোন, ভাবীরা সুখ-দুঃখের গল্প সুঁচের ফোড়ে ফোড়ে লিপিবদ্ধ করে। মনে পড়ে কত সুখময় অতীত, পুরোনো স্মৃতি, ভালো লাগার আলপনা। কখনো জানালার পাশে বসে গান শোনা, চোর ডাকাত খেলা, লুডু খেলা এছাড়া গল্পের আসরে মন মজে যায়। অশান্ত মনকে শান্ত করে দেয় এই বর্ষা। এর রূপ, সৌন্দর্য, অনুভূতি নিয়েই বাঙালি মন বারবার মুগ্ধ হয়। বৃষ্টি শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা বা প্রাকৃতিক পালাবদলের নিয়ামক নয় এর সঙ্গে ব্যক্তি জীবনও সম্পৃক্ত।
কেএসকে/জিকেএস