নাম মেছোবিড়াল। ইংরেজি নাম ‘ফিশিং ক্যাট’, আর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ফেলিস ভাইবেরিনা’। তবে মানুষের কাছে পরিচিত ‘মেছোবাঘ’ নামেই। এই ‘বাঘ’ ট্যাগ থাকার কারণেই প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় প্রাণীটি। এরা মূলত হাওর-বিল বা জলাভূমি সংলগ্ন বনের বাসিন্দা। তাই হাওরাঞ্চলের মানুষ এর নামের সঙ্গে ‘বাঘ’ শব্দটি যুক্ত করে হত্যা করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মেছোবিড়াল হত্যা বন্ধ করা না গেলে একদিন হারিয়ে যাবে প্রাণীটি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে জানা যায়, মেছোবিড়ালের দৈর্ঘ্য সাধারণত মাথা-দেহ ৭২ সেন্টিমিটার ও লেজ ২৯ সেন্টিমিটার। এটি বিড়ালদের মধ্যে বড় প্রাণী। দেহ সুঠাম ও মোটা, পা খাটো, মাথা দীর্ঘ ও লেজ ছোট। গাঢ় ধূসর দাগ ও ডোরার সমন্বয়ে দেহে আড়াআড়িভাবে সজ্জিত থাকে। লোম মোটা, স্পষ্ট কালো দাগসহ হালকা বাদামি ধূসর। দেহের দাগ খাড়াভাবে বিন্যস্ত। দেহের নিচের লোম দীর্ঘ এবং লেজে বলয় থাকে। কানের সামনে সাদা তিল আছে। পা ও পায়ের আঙ্গুল ধূসরাভ কালো। সাধারণত কণ্ঠস্বর নিরব থাকে। এরা নিশাচর প্রাণী।
নিঃসঙ্গভাবে শিকারের জন্য রাতে জলাভূমি ও মৎস্য খামারের পাশে ঘুরে বেড়ায়। এরা খুব ভালো সাঁতারু। খাবারের তালিকায় রয়েছে মাছ, শামুক-ঝিনুক ও ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী। মার্চ-জুন মাসে প্রজননকার্য সম্পন্ন করে। এটি সংকটাপন্ন প্রাণী। সব অঞ্চলের ঝোপঝাড়, বাঁশঝাড় ও জলাভূমি সমৃদ্ধ স্থানে দেখতে পাওয়া যায়। এ উপকারী প্রাণীটি সম্পর্কে গবেষকরা বলছেন, একে প্রকৃতিতে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম পন্থা হলো মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা।
- আরও পড়ুন:
শুধু মুরগি খাওয়ার অভিযোগে মেছো বিড়াল মারা অন্যায়
তানিয়ার সেবায় বাঘে-বিড়ালে বন্ধুত্ব
ঝিনাইদহে মেছো বিড়াল হত্যায় দুজনকে গ্রেফতার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক মনিরুল এইচ খান বলেন, মেছোবিড়ালের স্বভাব অনেকটা বন বিড়ালের মতো। তবে আকারে বন বিড়ালের চেয়ে বড়, প্রায় কুকুরের কাছাকাছি। বাংলাদেশের সর্বত্রই কমবেশি দেখা যায় মেছোবিড়াল। তবে জলাভূমি এলাকায় বেশি থাকে। এরা প্রধানত রাতে শিকার করে। প্রাণীটি জলাভূমির মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া ছাড়াও পোকামাকড় ও ইঁদুর খেয়ে কৃষকদের উপকার করে। তবে খাবারের সংকটে হয়তো এরা লোকালয়ে আসে। তখনই মানুষ তাকে হত্যা করে। এই হত্যা বন্ধ করতে হলে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মানুষের মধ্যে সচেতনতা এলে বন্যপ্রাণী হত্যা কমে যাবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্যমতে, বছর দুয়েক আগেও মেছো বিড়াল কিংবা মেছো বিড়ালের শাবকদের হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের আওতাধীন লাউয়াছড়া, সাতছড়ি কিংবা বর্ষিজোড়ার সংরক্ষিত বনে এনে অবমুক্ত করা হতো। এতে মেছোবিড়াল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো তাদের পরিবার থেকে। প্রাণীটি নতুন স্থানে এসে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে খাদ্য ও আবাস সংকটে পড়তো। এছাড়া প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধিও ব্যহত হতো।
বাচ্চার সঙ্গে একটি মা মেছোবিড়াল
আবার বিভিন্ন লোকালয় ডিঙ্গিয়ে হাওর তথা জলাভূমি সমৃদ্ধ ঝোপঝাড়ের দিকে পাড়ি জমাতো মেছো বিড়াল। ফলে প্রাণীটি লোকালয়ে পুনরায় ধরা পরার সুযোগ তৈরি হতো, নানাবিধ ধকল ও পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পাড়ায় দীর্ঘদিন প্রাণীটি খাবারের অভাবে ও স্বাস্থ্যগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় বংশ বৃদ্ধির স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হয়।
আরও পড়ুন:
- মানিকগঞ্জে বাঘ মনে করে মেছো বিড়াল ধরলো গ্রামবাসী
পাচার হচ্ছে বন্যপ্রাণী, লাগাম টানতে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ
‘মানুষের কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী'
অন্যদিকে মেছো বিড়ালের শাবক ধরা পরলে, এদের কৃত্রিম দুধ খাইয়ে বড় করে তোলার চেষ্টা করা হতো। যা বেশ কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল ছিল। মায়ের যত্নবিহীন বেশির ভাগ শাবককে এভাবে বাঁচানো যেতো না। কোনোভাবে দু-একটি বাঁচলেও স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গৃহপালিত প্রাণির মতো বেঁচে থাকত।
তবে এবার উদ্ধার হওয়া মেছোবিড়াল কিংবা এর শাবককে দূরের অন্য কোনো সংরক্ষিত বনে আর ছাড়া হচ্ছে না। এর পরিবর্তে এখন স্থানীয়দের বুঝিয়ে প্রাণীটিকে ধরা পড়ার স্থানেই অবমুক্ত করা হচ্ছে।
গবেষকদের দাবি, সুন্দরবন রক্ষায় বাঘের ভূমিকার অনুরূপে জলাভূমি রক্ষায় মেছো বিড়ালকে ফ্লাগসিপ প্রজাতি হিসেবে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মেছোবিড়াল অবমুক্ত করার পদ্ধতিতে সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ যেভাবে সফলতা পেয়েছে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে গড়ে প্রতি ১৫ দিনে মানুষের সঙ্গে মেছোবিড়ালের একটি সংঘাতের ঘটনার তথ্য এসেছে সংবাদমাধ্যমে। এই সমীক্ষায় নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশ।
সমীক্ষায় সংঘাত ঘটনার স্থান, স্থানের প্রকৃতি এবং মেছোবিড়াল অবমুক্তির স্থানের বিষয়টি লক্ষ্য করা হয়। এছাড়া সংঘাত কোন সময়, কোন ঋতু এবং কোন বছরে ঘটেছে সেটিও দেখা হয়। পাশাপাশি প্রতিটি সংঘাতের পেছনের কারণ, মানুষের প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তির ধরন এবং সংঘাতে জড়িত মেছোবিড়ালের সংখ্যা, মৃত উদ্ধার এবং অবমুক্তকৃত বিড়ালের সংখ্যাটিও লিপিবদ্ধ করা হয়।
২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংঘাতের খবরগুলো সংগ্রহ করা হয়। এতে মোট ৩৬১টি ঘটনায় ৫৬৪টি মেছোবিড়ালের সঙ্গে মানুষের সংঘাতের খবর পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল ৩৯৫টি পূর্ণবয়স্ক এবং ১৭০টি অপ্রাপ্তবয়স্ক বা বাচ্চা মেছোবিড়াল। এ ঘটনাগুলোতে ১৬০টি মেছোবিড়ালের মৃত্যুর খবর উঠে এসেছে।
এ সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা মাত্রই মেছো বিড়ালের ওপর আক্রমণাত্মক (অ্যাটাক অন সাইট) ও প্রতিশোধমূলক আচরণ দেখিয়েছে মানুষ। মাত্র ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মেছোবিড়ালের হাঁস-মুরগি খাওয়ার কারণে সংঘাতগুলো হয়েছে বলে গবেষণাটিতে উঠে এসেছে। প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে মেছোবিড়াল রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে। যার সবগুলোতেই মারা গেছে প্রাণিটি।
প্রতিশোধমূলক প্রবৃত্তির ধরন হিসেবে ধাওয়া করে মেছোবিড়ালকে আক্রমণ করার ব্যাপারটি প্রায় ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে। আর ২০ শতাংশ ঘটনায় ফাঁদ পেতে মেছোবিড়াল ধরা হয়েছে বলে সমীক্ষায় জানা যায়।
আরও পড়ুন:
- বন্যপ্রাণীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে
হাতিসহ বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বন বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশ জাগো নিউজকে বলেন, মেছোবিড়ালকে মানুষ চিনতে ভুল করছে। গায়ে কাটা কাটা দাগ থাকার কারণে বাঘ ও বাঘের বাচ্চা মনে করে ভুল করছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ দেখামাত্রই ভয় পাচ্ছে এবং মেরে ফেলতে চাচ্ছে। এটা শুধু মেছোবিড়ালের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য বন্যপ্রাণীর ক্ষেত্রেও হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মানুষ ও মেছোবেড়ালের সংঘাত দূর করতে হলে, প্রচার-প্রচারণা চালানো দরকার। শুধু মেছোবিড়াল না, বন বিড়ালও আছে। আরও অন্যান্য বন্যপ্রাণী আছে। এগুলো মানুষের জন্য কখনোই হুমকির কারণ না। এদের দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরা যুগযুগান্তর ধরে মানুষের সঙ্গে বসবাস করে আসছি। গ্রামীণ বনগুলা উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষের সঙ্গে প্রাণীর এই সংঘাত বাড়ছে।
অধ্যাপক মুনতাসির আকাশ বলেন, মেছোবিড়ালের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আরও কাজ করা দরকার। দেখা দরকার তারা কতটুকু মাছ খাচ্ছে। মৌলভীবাজারে দেখা গেছে, তারা প্রকৃতির খাবার খাচ্ছে আবার খামার থেকে হাঁস-মোরগও খাচ্ছে। তবে খামারে খুব কমই যাচ্ছে। মূলত ভয়ের কারণেই মানুষ মেছোবিড়ালকে মেরে ফেলছে। আরেকটা বিষয় মিডিয়াও কাজ করে। চটকদার হেডিংয়ের জন্য, কোথাও মেছোবিড়ালকে দেখা গেলে, সেটাকে বাঘ হিসেবে আখ্যা দিয়ে নিউজ করা।
তিনি বলেন, মেছোবিড়ালের যে বাচ্চাগুলো উদ্ধার হয়, বন্যপ্রাণী বিভাগ সেটাকে নিয়ে যায়। সেই দুধের বাচ্চাগুলা খুব ছোট থাকে। বন বিভাগ কিংবা সংশ্লিষ্ট যারা আছে তাদের আসলে তেমন সক্ষমতা নেই এদের লালন করে বড় করার। এটা কঠিন কাজ। সেক্ষেত্রে পুনর্বাসন কেন্দ্র দরকার। সবচেয়ে ভালো হয়ে প্রাকৃতিকভাবে যেখান থেকে ধরা হয়েছে সেখানে রাতে রেখে দেওয়া। তাহলে দেখা যাবে মা এসে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ভারসাম্য রক্ষা করে অবমুক্ত করা। মৌলভীবাজারে কিন্তু একই জায়গায় বন্য পানি অবমুক্ত করা কমিয়ে আনা হয়েছে। ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন জায়গায় মেছোবিড়ালকে অবমুক্ত করা হচ্ছে। সব বনেরই একটা ধারণ ক্ষমতা থাকে। যে জায়গায় অবমুক্ত করা হচ্ছে সেই জায়গায় ধারণ করার ক্ষমতা আছে কি না সেটা লক্ষ্য করতে হবে। একই জায়গায় বার বার ছাড়া হলে দেখা যাবে যে, ধারণ ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ওরা আবার লোকালয়ে চলে আসবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, মানুষের সঙ্গে মেছোবিড়ালের সংঘাতের পরিমাণ বেশি। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে বিভিন্নভাবে মানুষ মেছোবিড়াল ধরছে। এজন্য সচেতনতা সৃষ্টির কাজ চলছে। অনেক মামলাও হয়েছে। যখনই খবর পাচ্ছি উদ্ধার করে আবার প্রাকৃতিকভাবে অবমুক্ত করছি। জানকিছড়ায় আমাদের একটা রেসকিউ সেন্টার রয়েছে। সেখানে সাধ্যমতো যতটুকু সম্ভব আমরা আহত প্রাণীকে সুস্থ করার চেষ্টা চালাই।
ওমর ফারুক নাঈম/জেডএইচ/জেআইএম