বাজেটে বর্তমান শিল্প টিকিয়ে রাখার মতো কোনো নির্দেশনা নেই: বিসিআই

4 months ago 44

দেশের শিল্পখাত বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিবাহিত করছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেছেন, বাজেটে বর্তমান শিল্পগুলো টিকিয়ে রাখার মতো কোনো নির্দেশনা দেখতে পাচ্ছি না।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে শনিবার (৮ জুন) বিসিআই’র দেওয়া প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন তিনি।

তিনি বলেন, বাজেটে বর্তমান শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখার মতো কোনো নির্দেশনা দেখতে পাচ্ছি না। দেশের শিল্পখাত বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিবাহিত করছে। দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তার ৬০-৭০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সব প্রতিষ্ঠানের সেলস ড্রপ করেছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে নিয়মিত কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন সেবা পাচ্ছে না শিল্প।

পারভেজ বলেন, সরকারের সংকোচন নীতির এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্রাই আপ পলিসির কারণে ব্যাংক বন্ডে বিনিয়োগের দিকে উৎসাহিত হচ্ছে আবার সরকারও ব্যাংক থেকে টাকা নিচ্ছে। ব্যাংকের উচ্চ সুদহার এবং তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে। নতুন বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে এ বছর প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬.৬ শতাংশ।

তিনি বলেন, দেশে নতুন করে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বেকার হয়েছে। এর ফলে বর্তমান শিল্পের কস্ট অব ডুইং বিজনেস বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আমদানি বিকল্প শিল্প এবং কীভাবে কারখানাগুলোর সক্ষমতা টিকিয়ে রাখার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোনো দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

বিসিআই সভাপতি বলেন, এবারের বাজেট প্রস্তাবের শিরোনাম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’। সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি, কর জিডিপি অনুপাত না বাড়া ও রিজার্ভ ক্ষয় হওয়ার মতো অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য বাজেট প্রণয়ন খুবই কঠিন একটা কাজ। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হবে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রধান লক্ষ্য বলা হলেও টানা ১৪ মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পর্যাপ্ত পদক্ষেপ প্রস্তাবিত বাজেটে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

পারভেজ বলেন, রফতানি খাতে ইপিবির তথ্য অনুসারে দেখা যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ও কাস্টমসের তথ্যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে না। বিজিএমইএ ও বিকেএমই এর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রফতানি খাতের অবস্থা আশানুরূপ নয়।

তিনি বলেন, ইপিজেড এর শিল্পে কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির ক্ষেত্রে ১% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। একদিকে রফতানি আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে না, রেমিট্যান্সের প্রবাহ কম, রিজার্ভের স্বল্পতার মধ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অর্থনীতিকে আরো চাপে ফেলবে। আমরা এ প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা রফতানি খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটা দিকনির্দেশনা আশা করেছিলাম এ বাজেটে। বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে দেশের মাইক্রো, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে। এমন পরিস্থিতিতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাইক্রো, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প খাত। প্রস্তাবিত বাজেটে মাইক্রো, কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের টিকিয়ে রাখার কোনো দিকনির্দেশনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

আমরা পরিবেশ ও জ্বালানি সাশ্রয় নিয়ে কথা বলি কিন্তু এবারের বাজেটে দেখছি এলইডি লাইটের ওপর করারোপ করা হয়েছে। আবার দেশে উৎপাদিত এসি এবং ফ্রিজের ওপর করারোপ করা হয়েছে এর ফলে এখাত ক্ষতির মুখে পড়বে এবং সর্বোপরি চাপ এসে পড়বে ভোক্তার ওপর, বলেন বিসিআই সভাপতি।

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী নয়। বাজেট ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির অনুপাতে ৪.৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে যা আশাব্যঞ্জক। তার পরেও ঘাটতির ১ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে সংগ্রহ করা হবে। আমরা মনে করি সরকারের ব্যয় কমিয়ে এবং বিদেশি উৎস হতে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ঘাটতি মেটানোর দিকে জোর দেওয়া উচিৎ যেন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তুলনামূলক কম হারে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হয়।

এই বিপুল অর্থ যদি ব্যাংক ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হয় তাহলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে চাপ তৈরি হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন বিনিয়োগ না আসলেও বর্তমান শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অর্থ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা অত্যন্ত জরুরি।

তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ আয়কর প্রদানে কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা হয়েছে যা বিসিআই কোনোভাবেই সমর্থন করে না। এতে করে বৈধ অর্থ উপার্জনকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন এবং এটা তাদের জন্য শাস্তি স্বরূপ। তাছাড়া, জমি, প্লট, ফ্ল্যাট কেনার মতো অনুৎপাদনশীল খাতে এ কালো টাকা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যা যুক্তিসংগত নয়।

পারভেজ বলেন, জমি ও ফ্ল্যাট ক্রয়ে কালো টাকা ব্যবহার হলে জমির দাম বৃদ্ধি পাবে এবং শিল্পায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। কালো টাকা দেশের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে সেটা শিল্প ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিৎ। এর ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ থাকে।

তিনি বলেন, বিদ্যমান ডলার সংকট, আমদানিতে নানা ধরনের বিধিনিষেধ থাাকা, বিনিয়োগ ও উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি না হওয়া সত্ত্বেও রাজস্ব আদায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি তথা করনেট বৃদ্ধি না করে শুধু বিদ্যমান করদাতাদের করহার বৃদ্ধি করে আশানুরূপ কর জিডিপি অনুপাত অর্জন করা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, দেশে টিআইএন ধারির সংখা ১ কোটির কিছু বেশি তার মধ্যে রিটার্ন দিচ্ছে ৩৯ লাখের মতো এবং কর পরিশোধ করছে ২৬ লক্ষের মতো। আমরা মনে করি কর প্রদানকারীর সংখ্যা ১ কোটির ওপরে থাকা উচিত। প্রস্তাবিত বাজেটে করনেট বৃদ্ধিতে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা থাকা উচিত বলে বলে আমরা মনে করি।

বিসিআই সভাপতি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে মোট করের ৮০ শতাংশের ওপর সংগ্রহ হয়ে থাকে অথচ বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৪৫ শতাংশ অন্যান্য জেলায় অবস্থিত। এসব অঞ্চলে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মানুষের কাছে গেলে কর আদায় বৃদ্ধি পাবে এবং করনেট প্রসারিত হবে। ব্যবসায়ী এবং এনবিআরকে দায়িত্ব নিয়ে দেশের এই ক্রান্তি লগ্নে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা ছিল, সেটা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় করের সীমা ৫ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করছি। কোম্পানির জন্য করহার শর্তসাপেক্ষে ২.৫ শতাংশ কমানো হয়েছে যা আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক হলেও এই শর্ত প্রতিপালন করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয় কারণ বছরে ৩৬ লাখ টাকা নগদ অর্থে ব্যয়ের শর্ত মানা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অসম্ভব। আমরা কোনো প্রকার শর্ত ছাড়াই কর হার ২.৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করছি। এর ফলে বিনিয়োগ আকৃষ্টে সহায়ক হবে। শর্তসাপেক্ষে এই কর ছাড় শুভংকরের ফাঁকি ছাড়া আর কিছু নয়।

এমএএস/এমআরএম/জেআইএম

Read Entire Article