ইউরোপে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন তাকে পৌঁছে দিয়েছে এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে, যেখানে জীবনের বিনিময়ে হারাতে হয়েছে তার সর্বস্ব। লিবিয়ার মাফিয়াদের নির্মম নির্যাতন ও দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে অবশেষে দেশে ফিরেছেন ঝিনাইদহের নজরুল ইসলাম। তার হাতে পায়ে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন, আর মুখে ছিল এমন এক করুণ কাহিনি যা মানব পাচারের নির্মম বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথা জাগো নিউজের কাছে তুলে ধরেন নিঃস্ব-রিক্ত নজরুল ইসলাম।
তিনি জানান, ২০২৩ সালে ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দালালকে ১৬ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়া যান নজরুল ইসলাম। সেখানে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে ব্যর্থ হলে লিবিয়ার এক অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য তাকে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর শুরু হয় তার ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন।
নজরুল জানান, মাফিয়ারা তাকে হাত-পায়ে শিকল পরিয়ে মারধর করত এবং সেই ভিডিও তার পরিবারের কাছে পাঠাতো। ভয়ংকর এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তার পরিবার জমি-জমা বিক্রি করে এবং কিস্তি নিয়ে মোট ১৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দেয়। দালাল ও মাফিয়াদের দিতে গিয়ে মোট ৩০ লাখ টাকা খরচ করে তিনি আজ সর্বস্বান্ত। স্ত্রী ও সন্তান তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এখন তিনি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে দিশাহীন।
নজরুল ইসলাম বলেন, ২০২৩ সালে লিবিয়া যাওয়ার পর নয় মাস আমাকে বন্দী করে রাখে দালাল। সেখানেও গেম (বোটে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা) দিবে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আমার পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয়। এই ৯ মাস নির্যাতন না করলেও অনাহারে রেখে অনেক কষ্ট দেয়। এরপর গেম বোট দিলেও আমি যেতে পারিনি।
তিনি জানান, মাফিয়ার কাছে তিন মাস আমি বাথরুমের পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। পঁচা রুটি খেয়ে থাকতে হয়েছে। তারা মানুষের হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলে সেই ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠাতো। মাফিয়াদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লিবিয়ার জেলখানায়ও নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। সেখানে পুলিশ নিয়মিত মারধর করত এবং পকেট থেকে টাকা কেড়ে নিত। ঠিকমতো খেতে দিতো না।
নজরুল বলছেন, তার মতো অসংখ্য বাংলাদেশি লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে বন্দি এবং নির্যাতিত হচ্ছেন। লিবিয়ানরা ২০ হাজার দিনারে বাংলাদেশিদের মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়, যারা এরপর নির্যাতন করে ১০ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে।
এই পথে ইউরোপ যেতে যারা ইচ্ছুক তাদের উদ্দেশে নজরুল বলেন, দেশে ভিক্ষা করে খাওয়াও ভালো। যারা যেতে ইচ্ছুক তাদেরকে অনুরোধ করব এই মৃত্যুকূপে যেন না যায়। নিজেও শেষ পরিবারকেও শেষ হতে হয়।
শুধু নজরুল ইসলাম নয় বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) লিবিয়া ফেরত ১৭৫ জনের মধ্যে অধিকাংশ লিবিয়া থেকে মাফিয়ার কাছে কিংবা জেলখানায় নির্যাতনের শিকার হিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রের কাছে শত বাংলাদেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া লিবিয়া জেলখানাতেও রয়েছে শত শত বাংলাদেশি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্ডার এজেন্সি ফ্রন্টটেক্সের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৮ হাজার ৬৬৭ জন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকেছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৫৭৪ জন এসেছে কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর দিয়ে। আর ৬০৪ জন পূর্ব ভূমধ্যসাগর দিয়ে। বাকি ৪৩৭ জন ঢুকেছে পশ্চিমের বলকান দিয়ে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ২১ হাজার ৭০০ অবৈধ অভিবাসীকে ভূমধ্যসাগর থেকে আটক করেছে লিবিয়ার কোস্টগার্ড। এর মধ্যে দেড় হাজার নারী ও ৭০০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে ৪ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইতালি গেছেন। আর নৌকাডুবিসহ নানাভাবে মারা গেছেন ৭০০–এর বেশি মানুষ। আর ২০২৩ সালে সমুদ্রপথে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টার সময় নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ হাজার ৭৬০ জন অভিবাসী। এর মধ্যে কয়েক শ বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হয়।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৫–৪০ বছর বয়সীরা বেশি পাচারের শিকার হচ্ছেন। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জসহ অন্তত ১০–১২টি জেলার মানুষ ইউরোপ যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পাচারকারীরা প্রলোভন দেখাচ্ছে। তবে দেশে ফিরে মামলা করলেও মূল আসামিরা থেকে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই–মিসর, ইস্তানবুল–দুবাই, কাতার, অথবা সরাসরি লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩% মানুষ বন্দি হন। বন্দিদের ৯৩% ক্যাম্পে আটকে রাখা হয় এবং ৭৯% শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ৫৪% তিন বেলা খাবার পান না এবং ২২% দিনে মাত্র একবেলা খাবার পান। লিবিয়ায় যেতে যারা চেষ্টা করেছেন তাদের বেশিরভাগই মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বাসিন্দা। স্থানীয় দালালদের প্রলোভনে তারা বাড়ি বিক্রি করে রওনা দিয়েছেন, কিন্তু ৮৯% কোনো কাজ পাননি বরং নানা ঝুঁকিতে পড়েছেন।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশান প্রোগ্রাম) শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে বাংলাদেশিরা শীর্ষে। এই পাড়ি দেওয়ার জন্যই সবাই লিবিয়া গিয়ে মাফিয়ার হাতে পড়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বন্দিশালায় নির্যাতন করে পরিবার থেকে টাকা আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। এতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থতা লক্ষণীয়। তারা পাচারকারীদের ধরতে প্রযুক্তির ব্যবহারেও পিছিয়ে।
আরএএস/কেএইচকে/জিকেএস