বাস্তব রূপ নিচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর স্বপ্নের ‘ন্যাটো জোট’

5 hours ago 3

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে একের পর এক অস্থিরতা, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং কাতারের রাজধানী দোহায় সরাসরি হামলার ঘটনায় মুসলিম দেশগুলো এখন নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ সামরিক জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা এখন সবার কাছে স্পষ্ট। ফলে বহু বছর ধরে আলোচিত ‘মুসলিম ন্যাটো’ বা ‘আরব ন্যাটো’র ধারণা এখন নতুন করে বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে বলে আভাস মিলছে।

কাতারে হামলা এবং আরব বিশ্বের ক্ষোভ

৯ সেপ্টেম্বর দোহায় হামাস নেতাদের বৈঠকের সময় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় আবাসিক ভবন। প্রাণ হারান হামাসের শীর্ষ নেতা খলিল আল-হায়ার ছেলে, আরও কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী এবং কাতারের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। যদিও সংগঠনটির রাজনৈতিক শাখার শীর্ষ নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে যান, তবে এই হামলা উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—ইসরায়েল এখন আর আঞ্চলিক সীমারেখাকে মানছে না।

সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল, ইসরায়েল নাকি এই হামলার পরিকল্পনার কথা আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানিয়েছিল। এমন তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর উপসাগরীয় নেতারা পশ্চিমা প্রভাব থেকে সরে এসে নিজেদের জন্য বিকল্প পথ খোঁজার বিষয়ে আরও সিরিয়াস হয়ে উঠেছেন।

জরুরি বৈঠক ও প্রতিরক্ষার ঘোষণা

কাতারের ক্ষোভ প্রকাশের পর ১৫ সেপ্টেম্বর দোহায় ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) জরুরি বৈঠক ডাকে। সেখানে প্রায় ৬০টি মুসলিম দেশ প্রতিনিধিত্ব করে। অধিকাংশ নেতা একমত হন যে, ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামরিক ব্যবস্থা ছাড়া বিকল্প নেই।

১৯ সেপ্টেম্বর দোহায় জিসিসির যৌথ প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে। যেকোনো ধরনের বিদেশি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক যৌথ ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করে জোটটি। এর ফলে দীর্ঘদিনের ‘আরব ন্যাটো’ গঠনের ভাবনা নতুন মাত্রা পায়।

সৌদি-পাকিস্তান চুক্তি : জোটের দিকে বড় পদক্ষেপ

এ প্রেক্ষাপটে ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরব ও পাকিস্তান একটি ‘কৌশলগত যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি’ সই করে। এ চুক্তি শুধু দুই দেশের নয়, বরং পুরো মুসলিম বিশ্বের সম্ভাব্য সামরিক জোটের ভিত্তি বলে আখ্যায়িত হচ্ছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আরও ইঙ্গিত দিয়েছেন—সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যোগ দিতে পারে।

‘আরব ন্যাটো’ ধারণার ইতিহাস

‘আরব ন্যাটো’ কোনো নতুন ধারণা নয়। ২০১৫ সালে মিসরের শার্ম আল-শেখ সম্মেলনে প্রথমবার ন্যাটোর ধাঁচে একটি ঐক্যবদ্ধ বাহিনী গঠনের প্রস্তাব আসে। নীতিগতভাবে তা গৃহীত হলেও নেতৃত্ব, সদর দপ্তর এবং কমান্ড কাঠামো নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে উদ্যোগটি থেমে যায়।

এরপর ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে ইরানের প্রভাব ঠেকাতে গোপনে একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট গঠনের চেষ্টা চালায়। এতে ছয় উপসাগরীয় রাষ্ট্র ছাড়াও মিসর ও জর্ডানকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। যদিও প্রকল্পটি বাস্তবে রূপ নেয়নি, তবে ধারণাটি মুসলিম বিশ্বের সামরিক কৌশলে গভীর ছাপ রেখে যায়।

কেন জোট এখন জরুরি

বিশ্লেষকদের মতে, মুসলিম ন্যাটোর তাগিদ বেড়েছে কয়েকটি কারণে—

ইসরায়েলের আগ্রাসন : গাজায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ও দোহায় হামলা উপসাগরীয় দেশগুলোকে সতর্ক করেছে।

গ্রেটার ইসরায়েল পরিকল্পনা : ইসরায়েলের ডানপন্থি রাজনীতিকেরা ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া ও জর্ডান দখলের পরিকল্পনা প্রকাশ্যে বলছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা : ওয়াশিংটন ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ালেও আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

জনগণের ক্ষোভ : আরব বিশ্বের জনগণ গাজার গণহত্যা ও পশ্চিমা নীরবতায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছে।

সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা

তবে পথ মসৃণ নয়। আরব দেশগুলোর ভেতরেই রয়েছে বিভাজন। যেমন—

২০১৭ সালে সৌদি আরব, মিসর, ইউএই ও বাহরাইন কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করেছিল।

নেতৃত্ব কে নেবে, সদর দপ্তর কোথায় হবে—এ নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি।

তুরস্কের ভূমিকা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে। বহু আরব দেশ তুরস্ককে জোটের অংশ করতে চায় না।

এ ছাড়া অতীতে জিসিসি কোনো সদস্যদেশের ওপর হামলার সময় যেমন সৌদি আরব বা ইউএই-তে হুতিদের ড্রোন হামলার ঘটনায় জোটটি একত্রিত হয়ে সামরিক পদক্ষেপ নেয়নি। তাই ন্যাটোর মতো দৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে কাঠামোগত ও কৌশলগত বড় পরিবর্তন দরকার।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

তবুও সৌদি-পাকিস্তান চুক্তি এবং দোহায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্ট করেছে, মুসলিম দেশগুলো আর আগের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে চাইছে না। আন্তর্জাতিক আদালতের সাম্প্রতিক রায়, যেখানে ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে অবৈধ বলা হয়েছে, তাও মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পক্ষে একটি অনুঘটক হয়ে উঠেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, মুসলিম ন্যাটো বা আরব ন্যাটো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিরাট। যদি এটি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির মানচিত্র আমূল বদলে যাবে। শুধু ইসরায়েল নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-চীনকেও নতুন করে কৌশল আঁকতে বাধ্য করবে।
 

Read Entire Article