বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত ঢাকা, সমাধানে একগুচ্ছ পরামর্শ

3 months ago 11

কোনোভাবেই কমছে না ঢাকার বায়ুদূষণ। বরং দূষণের অবস্থার অবনতি হয়েছে। বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় দূষিত শহরের তালিকায় নিয়মিত শীর্ষস্থানে থাকছে ঢাকা।

গত ৫ মে বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসে ঢাকা। সেদিন সকাল ৮টা ১৯ মিনিটে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক থেকে জানা যায় এ তথ্য। সেদিন ঢাকার বায়ুর মানের স্কোর ছিল ১৯৮। এর অর্থ দাঁড়ায় এখানকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে।

১৬ মে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ঢাকার বায়ুমান ছিল ১৮৪। বুধবার (২১ মে) সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে ১৬২ স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। কিন্তু বিকেলে ঢাকায় ঝুম বৃষ্টি হওয়ায় এই স্কোর নেমে আসে ৬৯-এ। তালিকার ২৫ নম্বরে আসে ঢাকার নাম।

এই চিত্র এক-দুদিনের নয়। প্রায় দিনই বাতাসের গুণমান সূচকে এমন চিত্র উঠে আসছে।

বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত ঢাকা, সমাধানে একগুচ্ছ পরামর্শ

বায়ুদূষণের ফলে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে নাগরিকরা। বিশেষ করে শিশু ও নারীরা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় পড়ছেন। সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের পাশাপাশি নাগরিকদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান চিকিৎসকের।

মানুষ, অন্যান্য জীবিত প্রাণী বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বায়ুতে এমন পদার্থের উপস্থিতিই বায়ুদূষণ। এটা ওজোন বা নাইট্রোজেন অক্সাইডের মতো গ্যাস, কাচের মতো ছোট কণা বা সিসার মতো অন্য রাসায়নিক হতে পারে। এটি বহিরঙ্গন বায়ু এবং অভ্যন্তরীণ বায়ু উভয়কেই প্রভাবিত করে। এজন্য বায়ুদূষণ পরিবেশগত ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত দুই ধরনের হতে পারে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে অকালে মৃত্যুর শতকরা ৮৯ শতাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে হয়।

বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষণযুক্ত বায়ুতে শ্বাস নেয়। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে প্রায় এক লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মৃত্যুবরণ করেন, যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ৫০ হাজার বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের অনেক কারণ, এর মধ্যে উন্নয়ন কার্যক্রম একটি। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, ভবন নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ, যত্রতত্র ইটের খোয়া, বালু, মাটিসহ নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা, যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলে রাখা এবং সময় মতো পরিষ্কার না করা। সবগুলোই বায়ুদূষণকে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ফেলছে। অনেক জায়গায় ময়লা পোড়ানো হয়, এগুলো বায়ুদূষণকে আরও তীব্র করে তুলছে।

কোনোভাবেই কমছে না ঢাকার বায়ুদূষণ। বরং দূষণের অবস্থার অবনতি হয়েছে। বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় দূষিত শহরের তালিকায় নিয়মিত শীর্ষস্থানে থাকছে ঢাকা

বায়ুদূষণের অস্বাস্থ্যকর প্রভাব নিয়ে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহর সঙ্গে কথা বলে জাগো নিউজ। তিনি বলেন, ‘ঢাকাসহ সারাদেশে বায়ুদূষণ মারাত্মক সমস্যা। শিশু, বৃদ্ধ সবাই স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন। এতে আমাদের জীবনযাত্রা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা হয়। মূল সমস্যাটা শ্বাসতন্ত্রের ওপর বেশি হয়। চোখে সমস্যা হয়, লাল হয়, চোখে এলার্জির ভাব হয়, চোখ দিয়ে পানি ঝরে। নাকে হাঁচি হয়, নাক বন্ধ হয়। টনসিলাইটিস, ফেনিনজাইটিস, জাইনাইটিস, সাইনোসাইটিস এগুলো হয়। বুকের মধ্যে নিউমোনিয়া হয়। অ্যাজমা-শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি বাড়ে, ব্রংকাইটিস হয়। এছাড়া দীর্ঘদিন বায়ুদূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হয়। মস্তিস্ক, লিভার ও কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষতি আরও বেশি। তাদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটে না। গর্ভবতী নারীদের সমস্যা হয়। গর্ভের সন্তানের জন্মগত ত্রুটি হয়, হাবাগোবা হয়। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতাসহ নানা ঝুঁকি বাড়ে। এগুলো বায়ুদূষণের মূল সমস্যা।’

কোনোভাবেই কমছে না ঢাকার বায়ুদূষণ। বরং দূষণের অবস্থার অবনতি হয়েছে। বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় দূষিত শহরের তালিকায় নিয়মিত শীর্ষস্থানে থাকছে ঢাকা

সরকারের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতার ওপর গুরুত্বারোপ করে এই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বলেন, ‘এখানে সরকার ও জনগণের দায়-দায়িত্ব আছে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না। নিজের ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বর্জ্য ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। এগুলো যেন বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা হয়। প্রশাসনের দায়িত্ব হলো উন্নয়ন কাজগুলো যেন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়, সুন্দর হয়। বিশেষ করে ইটভাটায় যেন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। যত্রতত্র ইট, বালু ও সিমেন্ট যেন না রাখে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং দিনেরাতে পানি ছিটাতে হবে। কলকারখানা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যেন বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যত্রতত্র ময়লা না ফেলে। এজন্য প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে, জনগণকেও সতর্ক থাকতে হবে। বায়ু দূষণরোধে সবুজায়ন দরকার। প্রচুর গাছ লাগানো দরকার। সর্বোপরি জনসাধারণকে সতর্ক করার লক্ষ্যে এগুলোর ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা জরুরি।’

এ নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কোনো কার্যক্রমের কারণে বায়ুদূষণ কমেনি। বায়ুদূষণ কমছে প্রাকৃতিক কারণে। বৃষ্টি হচ্ছে এইজন্য। এখানে সিটি করপোরেশন বা কারও কোনো ক্রেডিট নেই।’

মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘বায়ুদূষণ যেসব কারণে হয়, যেখানে ময়লা রাখা হয়, পরিষ্কার করছি, ঝাড়ু দিচ্ছি, পানি ছিটানো হচ্ছে, নির্মাণ কাজেও তদারকি করছি। আমাদের নিয়মিত সব কাজই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। শুধু পুরাতন গাড়িগুলো সরাতে পারছি না। এগুলো বিআরটিএর কাজ।’

এসইউজে/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article