বর্ষার শুরুতেই পিরোজপুরে জমে উঠেছে মাছ ধরার চাঁইয়ের হাট। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সপ্তাহে দুদিন বসছে এ হাট। হাটে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কারিগররা চাঁই নিয়ে আসছেন। বিক্রির ধুম থাকলেও বিক্রেতারা বলছেন, উৎপাদন খরচ বাড়ায় সে অনুযায়ী ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারছেন না তারা। ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ পেশায় টিকে থাকতে তারা সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
জানা যায়, পিরোজপুরে বর্ষা এলে মাছ ধরার চাঁইয়ের বেচাকেনা বেড়ে যায়। বর্ষায় গ্রামবাংলার জনজীবনে আসে এক বিশেষ ব্যস্ততা। নতুন পানিতে ভরে ওঠা খাল, বিল, নদীনালা ও ধানক্ষেতের জলাশয়ে ছুটে আসে দেশীয় নানা প্রজাতির মিঠাপানির মাছ। ঠিক তখনই বাড়ে মাছ ধরার হিড়িক। আর সেই সঙ্গে বাজারে বেড়ে যায় মাছ ধরার ফাঁদ চাঁইয়ের চাহিদা ও বিক্রি।
বর্ষা মৌসুমে গ্রামের মানুষ বিশেষত কৃষিজীবী পরিবারগুলো মাছ ধরার জন্য বাঁশের তৈরি চাঁই, খালোই, কুড়া, খাঁকি, ছিপ ইত্যাদি ব্যবহার করেন। তবে পিরোজপুরে চাঁই হলো সবচেয়ে প্রচলিত ফাঁদ, যা সহজে মাছ ধরতে ব্যবহৃত হয়। এই ফাঁদ সাধারণত স্রোতের বিপরীতে বসিয়ে মাছ ধরা হয়, যেখানে মাছ ঢুকলেও সহজে বের হতে পারে না।
- আরও পড়ুন:
- ঐতিহ্য হারাচ্ছে শতবর্ষী হাট-বাজার
- টিকে থাকার লড়াইয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা
- মৃৎশিল্পে জীবন চলছে না কুমারদের
বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই পিরোজপুর জেলা সদর, নাজিরপুর, নেছারাবাদসহ বিভিন্ন উপজেলার হাটবাজারে চাঁইয়ের বেচাকেনা জমে উঠেছে। এসব হাটে পাইকারি ও খুচরা ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে মাছ ধরার চাঁই। পিরোজপুর সদর উপজেলায় দামোদর নদীর তীরে পালপাড়া সড়কের পাশে সপ্তাহে রোববার ও বুধবার, নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানায় সোমবার ও শুক্রবার এবং নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান হাটে শনিবার ও মঙ্গলবার চাঁইয়ের হাট বসে। প্রতি হাটে দুই থেকে তিন হাজার চাঁই বিক্রি হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে এসব হাটের বেচাকেনা।
শহরের দামোদর নদীর তীরে পালপাড়া সড়কের পাশের হাট ঘুরে দেখা যায়, বাঁশের তৈরি চাঁইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন কারিগরেরা। কেউ বিক্রি করছেন, কেউ অর্ডার নিয়ে তৈরি করছেন নতুন চাঁই। হাটে চাঁই কিনতে এসেছেন আশপাশের কৃষক ও জেলেরা। বিভিন্ন আকার-আকৃতির এসব চাইয়ের দাম ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে।
প্রতিবছর বর্ষার শুরু থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চাঁই বিক্রি হয়। এসময় বৃষ্টিতে খাল-বিলসহ বাড়ির আশেপাশের ছোট-বড় জলাশয় নতুন পানিতে ভরে যায়। নদীসহ বিভিন্ন পুকুরের মাছ ছুটে প্রবেশ করে খালবিলসহ আশেপাশের জলাশয়ে। এসময় বাঁশের তৈরি এসব চাঁই দিয়ে মাছ ধরার ধুম পড়ে।
কারিগররা জানান, একটি চাঁই তৈরিতে সময় লাগে প্রায় একদিন। আকার ও মানভেদে দাম পাওয়া যায় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। বাঁশের তৈরি একেকটি চাঁই এক বছর ব্যবহার করা যায়।
চাঁই বিক্রেতা তপন কুমার দাস বলেন, ১৫ বছর ধরে এই বাজারে চাঁই বিক্রি করছি। ১৪০০ থেকে ১৫০০ মানুষ চাঁই তৈরি করে ও সেগুলো বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসে। আমি এবছর ১৭০০ থেকে ১৮০০ চাঁই তৈরি করে পিরোজপুর বাজারে বিক্রি করবো। এই মৌসুমে আড়াই লাখ টাকার চাই বিক্রি করা আশা। এখন সুতার দাম বেড়ে গেছে। আগে যে সুতা কিনতাম ১০০ টাকায় এখন তা কিনতে হয় ৩৫০ টাকায়। এছাড়া বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। সরকার যদি আমাদের বিনা সুদে লোন দিত তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।
চাঁই কিনতে আসা সরোয়ার শেখ বলেন, ১৮টি চাঁই কিনেছি। চিংড়ি, বাইন মাছ, টাকিসহ অন্যান্য মাছ এই ফাঁদে ধরা পড়ে। এই চাঁইয়ে যে মাছ ধরা পড়ে তাতে আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে খেতে পারি। প্রতিবছর বছরের ৩ মাস এভাবে মাছ ধরি।
পিরোজপুর সদরের শারিকতলা থেকে চাঁই ও গড়া কিনতে আসা কাওসার আহমেদ বলেন, এক কুড়ি গড়ার দাম ৪০০ টাকা বলেছি কিন্তু বিক্রেতা দেয়নি। বিক্রেতা ৫০০ টাকা বলেছেন, ৫০০ টাকার কমে সে বিক্রি করবে না। প্রতিটা চাঁইয়ে ১০০ গ্রাম থেকে ১৫০ গ্রাম চিংড়ি মাছ ধরা পড়ে। দুই কুড়ি চাঁই পাতলে দেড় থেকে দুই কেজি মাছ ধরা পড়ে।
চাই তৈরির কারিগর শিশির ডাকুয়া বলেন, প্রথমে ২০ ইঞ্চি চিকন শালা বানাই। তারপরে নিজ হাতে সুতা দিয়ে বোনাই। এভাবে তৈরি করে আমরা বাজারে নিয়ে আসি। প্রতি কুড়ি চাঁই ২৫০০ থেকে ৩ হাজার ৩৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। বর্তমানে বাজার ভালো যাচ্ছে না, উৎপাদন খরচও উঠছে না। আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। বর্তমানে প্রতিটি চাঁই বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে থেকে ১১৫ টাকায়। কিছুদিন আগেও একেকটি চাঁই দেড়শ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পিরোজপুর সাপ্তাহিক হাটে গড়া বিক্রি করতে আসা নির্মল দাস বলেন, বাঁশ দিয়ে আমাদের গড়া তৈরি করতে হয়। আমাদের যে পরিমাণ ব্যয় হয়, সেভাবে আমরা আয় করতে পারছি না। ১০ বছর যাবত এগুলো উৎপাদন করে আসছি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কোনো আয় হয় না। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করে তাহলে আমরা ভালোভাবে থাকতে পারতাম।
পিরোজপুর জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহসানুল কবির বলেন, পিরোজপুরের চাঁইয়ের হাট বহু বছরের পুরোনো। এই হাট আগে অনেক বেশি জমজমাট ছিল। আধুনিকতার কারণে মাছ ধরার এই সরঞ্জামটি দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। জেলা ব্যবসায়ী সমিতি এই ব্যবসায় জড়িতদের দেখভাল করে আসছে। হাটের দিন তাদের চাঁই বেচা বিক্রিতে কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।
পিরোজপুরে বর্ষা মৌসুমে চাঁই তৈরি পেশায় কয়েকশ পরিবার জড়িত। প্রতি মৌসুমে প্রতিটি পরিবারের দেড় থেকে দুই লাখ টাকা হয়।
এমএন/এএসএম