দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
গতকাল মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনপূর্তি এবং বিচারবিভাগের সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভা থেকে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠাসহ বিচারকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণে অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বুধবার (২০ নভেম্বর) অ্যাসোসিয়েশনের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিচার বিভাগের অর্থবহ স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয় এরই মধ্যে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন, যা বর্তমানে সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, বিচার বিভাগ পৃথককরণ-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলায় সরকারের প্রতি যে ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, তার ৮ম দফায় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করে বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এটি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইন ও বিধিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ওই রায়ের ৭ম দফায় বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে সুপ্রিম কোর্টের প্রাধান্য নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মাসদার হোসেন মামলার উল্লিখিত ৭ম ও ৮ম দফার নির্দেশনা মোতাবেক বিচার বিভাগের ওপর সুপ্রিম কোর্টের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে কিংবা আইন ও নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত করে বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ জুডিসিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
এর আগে গত ২৭ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নির্দেশনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
পৃথক সচিবালয়সংক্রান্ত সুপ্রিমকোর্টের ধারণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রয়োগের প্রবণতার যে চর্চা অব্যাহত রয়েছে, তা রোধ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এর ফলে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি আমাদের দেশে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা চর্চার সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথককরণ নিশ্চিতকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ধারণাপত্রে আরও বলা হয়, দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখার কথা বলা হলেও সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ দেশে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথককরণ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এমন একটি প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ নম্বর সিভিল আপিল মামলার রায়ে (মাসদার হোসেন মামলা নামে পরিচিত) নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথককরণের পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে ক্ষমতার পৃথককরণ নীতির বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে দিয়েছে।
ধারণাপত্রের ভাষ্য, ওই রায়ে ক্ষমতার পৃথককরণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে একাধিকবার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে বিচার বিভাগ পৃথককরণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রসঙ্গ এসেছে। আর বিচার বিভাগ পৃথককরণের সর্বোত্তম কার্যকর উপায় স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। এ কারণে ওই মামলার রায়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বর্তমানে প্রচলিত দ্বৈত-শাসন কাঠামো তথা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের যে যৌথ এখতিয়ার রয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাকে ক্ষমতার পৃথককরণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
ধারণাপত্রে বলা হয়, এ কথা সত্য যে বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক সরকারের অনীহার কারণে বিচার বিভাগের পৃথককরণ সম্ভবপর হয়নি। এ কারণে বিগত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বর্তমান সময় হচ্ছে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের শ্রেষ্ঠ সময়। এ প্রচেষ্টার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ হতে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা। কেননা, কেবল পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই দেশে দক্ষ, নিরপেক্ষ ও মানসম্পন্ন বিচারকাজের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
ধারণাপত্রে আরও বলা হয়, আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি অধস্তন আদালতের বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তথা হাইকোর্ট বিভাগকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ নয়। কেননা, বিদ্যমান কাঠামোতে আইন মন্ত্রণালয় হতে অধস্তন আদালতসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব আসার পর হাইকোর্ট বিভাগ তার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের মর্ম অনুসারে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের একচ্ছত্র অধিকার। তাই সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক।
ধারণাপত্রের শেষাংশে বলা হয়, এ ছাড়া বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের মামলার সংখ্যা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি, অধস্তন আদালতের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মপরিধি আগের তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক একটি সচিবালয় স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে কেবল পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও অন্যান্য বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব।