বিজিএমইএকে প্রকৃত রপ্তানিকারকদের সংগঠন হিসেবে দেখতে চান সদস্যরা

2 hours ago 4

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের চলমান অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় সেটি ভেঙে দিয়েছে সরকার। প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেনকে।

বিজিএমইএতে প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে সংগঠনটির সাবেক নেতা ও সদস্যরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা মনে করেন, এটি প্রকৃত রপ্তানিকারকদের ভোটাধিকারের সঙ্গে সংগঠনের নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কার করার একটি সুযোগ। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে সদস্যদের ভোটাধিকারের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। কারণ নির্বাচনী মঞ্চের দুটি প্যানেলের মধ্যে আলোচনা ও পরিচালক পদের ভাগাভাগি ছিল, যেখানে সাধারণ ভোটারদের মতামতের প্রকাশ ঘটেনি।

সাধারণত সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরাম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিজয়ী প্যানেল তাদের মধ্যে থেকে সভাপতি নির্বাচিত করে বোর্ড গঠন করে। বিগত নির্বাচনে এস এম মান্নানের (কচি) নেতৃত্বে সম্মিলিত পরিষদ ২০২৪-২৬ মেয়াদে অনুষ্ঠিত বিজিএমইএ নির্বাচনে ৩৫টি পরিচালক পদে জয়ী হয় এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে ফোরাম অভিযোগ করে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।

গত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সদস্য ও অন্য নেতারা এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেননি। ফলস্বরূপ বিজিএমইএ সঠিক নেতৃত্ব পায়নি, যা শিল্পে সাম্প্রতিক অস্থিরতার সময় দেখা গেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতা পোশাক রপ্তানিকারকদের ভোগান্তি বয়ে আনে।- বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী পারভেজ

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস এম মান্নান (কচি) দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। খন্দকার রফিকুল ইসলাম সভাপতি নির্বাচিত হন। পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ এ খাতের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারায় বর্তমান সরকার পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে। ফলে পরাজিত প্যানেল ফোরাম এবং সাধারণ সদস্যরা মনে করছেন এটা একটা বড় সুযোগ বিজিএমইএর নির্বাচনী সংস্কারের, যেখানে সবার ভোটাধিকার থাকবে।

প্রশাসকের কাছে প্রত্যাশা

ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রশীদ আহমেদ হোসাইনী বলেন, ‘অনির্বাচিত সরকারের অধীনে ভুয়া ভোটারের মাধ্যমে সবশেষ বোর্ড নির্বাচিত হয়েছিল। বোর্ডটি ছিল অবৈধ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা উপলব্ধি করে বোর্ড ভেঙে দিয়েছে।’

‘আমাদের একমাত্র দাবি ভুল ভোটার তালিকা সংশোধন করা এবং সেরা যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য প্রকৃত রপ্তানিকারকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আমরা হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল ও ফ্যাক্টরি চলছে কি না তা যাচাই করে প্রকৃত ভোটার নির্বাচন করার পরামর্শ দেবো।’ বলেন রশীদ।

ফ্যাশন ডটকম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান মনিরুল আলম (শুভ) জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত দুই বিজিএমইএ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি এবং কীভাবে ভোট কারচুপি হয়েছে তা দেখেছি। জাতীয় নির্বাচনে যা দেখা গেছে তার চেয়েও খারাপ ছিল ওই নির্বাচন। বিশেষ করে গত নির্বাচন আমাকে চরমভাবে নিরুৎসাহিত করেছে, যেখানে গণমাধ্যমও ভোট কারচুপি দেখেছে।’

মনিরুল বলেন, ‘সদ্য বিলুপ্ত হওয়া বিজিএমইএ বোর্ডে (সম্মিলিত পরিষদ থেকে) অনেককে পেয়েছি যারা এত বড় দুর্নীতির বিষয়ে নীরব ছিলেন। আশা করি এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্প সেক্টরের জন্য নতুন দিনের সূচনা করবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিএমইএর এক সদস্য বলেন, ‘সরকার যেহেতু একজন প্রশাসক নিয়োগ করেছে, তাই প্রকৃত রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি বড় সুযোগ। দুটি প্রতিযোগী প্ল্যাটফর্মের মধ্যে জাল ভোটার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ রয়েছে। কিন্তু এটা সমাধান করা হয়নি। এমন সদস্য আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করেন না, কিন্তু তারা ভোটার থাকেন এবং ভোট দেন। এটি ঠিক করা উচিত। ’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘গত নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সদস্য ও অন্য নেতারা এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেননি। ফলস্বরূপ বিজিএমইএ সঠিক নেতৃত্ব পায়নি, যা শিল্পে সাম্প্রতিক অস্থিরতার সময় দেখা গেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতা পোশাক রপ্তানিকারকদের ভোগান্তি বয়ে আনে।’

‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সত্যতা অনুধাবন করে প্রশাসক নিয়োগ করেছে। ভুয়া ভোটার অপসারণের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশাসকের কাছে আমাদের প্রত্যাশা। প্রায় সাতশ ভুয়া ভোটার রয়েছে। তাদের কারখানা চালু নেই। আমাদের উচিত ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাই করা এবং সদস্যদের নেতা নির্বাচনের জন্য ভুয়া ভোটারদের বাতিল করা।’

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চান সদস্যরা

এদিকে সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। তাদের যুক্তি, সময়ক্ষেপণ হলে ব্যবসার ক্ষতি হবে।

বিজিএমইএর সদস্য ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘যদিও সরকার চার মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, আমি মনে করি এই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন করতে যত বিলম্ব হবে, ততই এ খাতের ক্ষতি হবে। কারণ প্রশাসক রপ্তানিকারকদের পক্ষে দর কষাকষি করতে পারবেন না।’

যে কারণে ভেঙে দেওয়া হলো বোর্ড

বিজিএমইএর পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এস এম মান্নান (কচি) পরিচালনা পর্ষদের কাছে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু পর্ষদ পুনর্গঠিত হলেও গঠন প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ। অন্যদিকে, সাধারণ সদস্যদের উপস্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের প্রতিনিধিরা সন্তোষজনক জবাব উপস্থাপন করতে পারেননি।

যদিও সরকার চার মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে, আমি মনে করি এই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন করতে যত বিলম্ব হবে, ততই এ খাতের ক্ষতি হবে। কারণ প্রশাসক রপ্তানিকারকদের পক্ষে দর কষাকষি করতে পারবেন না।- বিজিএমইএর সদস্য ফজলে শামীম এহসান

পোশাক শিল্পের চলমান অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএর পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বর্তমান পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের সমন্বয়হীনতার কারণে বাণিজ্য সংগঠন আইন, ২০২২ এর ১৭(১) অনুযায়ী-ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্য ও সেবাখাতের স্বার্থে সংগঠনটির সার্বিক কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না মর্মে প্রতীয়মান। তাই বোর্ড ভেঙে দেওয়া হলো।

যদিও বলা হয়েছে পরিচালনা পর্ষদের ব্যর্থতার কারণে বোর্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অন্য কারণও রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তারা বলছেন, নির্বাচন অবৈধ ও কারচুপি হয়েছে। বোর্ড ভেঙে দেওয়ার জন্য ফোরামের চাপ ছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজিএমইএ সদস্য জাগো নিউজকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ফোরাম থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বোর্ড পুনর্গঠনের একটি প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু অন্য সদস্যদের বিরোধিতার কারণে তা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোর্ডের একজন পরিচালক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভুয়া ভোটার এবং সরকারি বাছাই করা সদস্যদের সভাপতি নির্বাচিত করার জন্য চাপের মতো কিছু বিষয় ছিল। তবে আশা করি প্রশাসক ভোটার তালিকা সংশোধন করবেন এবং প্রকৃত রপ্তানিকারকদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন।

আইএইচও/এএসএ/জেআইএম

Read Entire Article