বিজেপি কেন নীতীশ কুমারকেই আবারও মুখ্যমন্ত্রী করলো?
বৃহস্পতিবার যখন নীতীশ কুমার দশম বারের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছিলেন, তা আগের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিল। আগে কখনো নীতীশ কুমারকে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে এত অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়নি। যদি নীতীশ কুমারের ভাষণের রেকর্ডগুলো দেখা যায়, তাহলেই বোঝা যায় যে তিনি কতটা আত্মবিশ্বাসী। এছাড়াও তিনি এমন একজন নেতা, যিনি শুদ্ধ হিন্দি বলার জন্যও পরিচিত। তবে এবারে তার গলায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তারপরেও বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমার প্রাসঙ্গিক। যে জোটের সঙ্গে নীতীশ কুমার থেকেছেন ২০০৫ সাল থেকে, সেই জোটই ক্ষমতাসীন হয়েছে। সেবছর থেকেই লালু প্রসাদ ইয়াদভের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) অথবা বিজেপি কেউই এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। নীতীশ কুমার ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো বিধায়ক হয়েছিলেন, তাই তার রাজনৈতিক জীবন এখন শেষ প্রান্তে, তবুও তার প্রাসঙ্গিকতা এখনও রয়ে গেছে। সেজন্যই প্রশ্ন ওঠে যে বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমারের বিকল্প কেন নেই? তার দল জনতা দল ইউনাইটেড ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৪৩টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা সত্ত্বেও বিজেপি নীতীশ কুমারকেই মুখ্যমন্ত্রীর পদ
বৃহস্পতিবার যখন নীতীশ কুমার দশম বারের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছিলেন, তা আগের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিল। আগে কখনো নীতীশ কুমারকে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে এত অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়নি।
যদি নীতীশ কুমারের ভাষণের রেকর্ডগুলো দেখা যায়, তাহলেই বোঝা যায় যে তিনি কতটা আত্মবিশ্বাসী। এছাড়াও তিনি এমন একজন নেতা, যিনি শুদ্ধ হিন্দি বলার জন্যও পরিচিত।
তবে এবারে তার গলায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তারপরেও বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমার প্রাসঙ্গিক। যে জোটের সঙ্গে নীতীশ কুমার থেকেছেন ২০০৫ সাল থেকে, সেই জোটই ক্ষমতাসীন হয়েছে। সেবছর থেকেই লালু প্রসাদ ইয়াদভের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) অথবা বিজেপি কেউই এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারেনি।
নীতীশ কুমার ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো বিধায়ক হয়েছিলেন, তাই তার রাজনৈতিক জীবন এখন শেষ প্রান্তে, তবুও তার প্রাসঙ্গিকতা এখনও রয়ে গেছে। সেজন্যই প্রশ্ন ওঠে যে বিহারের রাজনীতিতে নীতীশ কুমারের বিকল্প কেন নেই?
তার দল জনতা দল ইউনাইটেড ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৪৩টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা সত্ত্বেও বিজেপি নীতীশ কুমারকেই মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসায়। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি সব থেকে বেশি আসন পাওয়ার পরেও নীতীশ কুমারই মুখ্যমন্ত্রী করতে হয়।
নীতীশ কুমার: ২০০৫ থেকে ২০২৫
নীতীশ কুমার কেবল বিহারেই নয়, পুরো ভারতীয় রাজনীতিতেই এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। বিহারের দীর্ঘতম সময়ের জন্য মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন নীতীশ কুমার এবং আবারও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন।
বিহারের রাজনীতিতে তিনটি বড়ো দল রয়েছে- আরজেডি, বিজেপি এবং জেডিইউ। লালু প্রসাদ যাদব এবং রাবড়ি দেবীর যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিরোধী দলগুলো সেই সময়টাকে ‘জঙ্গলরাজ’ বলে সমালোচনা করতো। বিজেপি তো প্রকাশ্যেই হিন্দুত্বের রাজনীতি অনুশীলন করে, অন্যদিকে জেডিইউ এই দুইয়ের মাঝামাঝি থেকে নিজেদের জন্য একটি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে নিয়েছে।
জেডিইউ ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই নিজেদের সমাজবাদী দল বলে দাবি করে থাকে।
নীতীশ কুমারের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রবীণ সাংবাদিক সুরুর আহমেদ বলছিলেন, নীতীশ কুমার ১৯৭৭ এবং ১৯৮০ সালের নির্বাচনে হেরে যান। ১৯৯০ সালে যখন লালু প্রসাদ যাদব রাজনীতির ময়দানে এলেন, তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য বিজেপির দরকার ছিল একজন অন্যান্য পশ্চাৎপদ জাতি গোষ্ঠী বা ওবিসি মুখ।
সেই মুখই হয়ে ওঠেন নীতীশ কুমার এবং বিজেপি তাকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে। কিন্তু ২০১০ সালে ব্যাপক জয়ের পরে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ করা নিয়ে বিজেপির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিজেপির সঙ্গে নীতীশ কুমারের দূরত্ব বাড়ে।
বিজেপির সঙ্গে প্রায় ১৭ বছরের পুরোনো জোট ভেঙে বেরিয়ে আসেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইয়ের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়েন, তবে তার দল মাত্র দুটি আসনে জয়ী হয়।
এর অর্থ হলো, নীতিশ কুমারও জানেন যে জোট ছাড়া তিনি বিহারের রাজনীতিতে টিকতে পারবেন না। অর্থাৎ একদিকে বিজেপি অন্যদিকে আরজেডি-এই দুই দলের বিরুদ্ধে এক সঙ্গে লড়াই করতে পারবেন না, এটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
নীতীশের রাজনীতি
বিহারে কেবল দুটি দল ক্যাডার-ভিত্তি দল আছে - বিজেপি এবং বামপন্থি দলগুলো। আরজেডির নিজস্ব জনভিত্তি হলো মুসলিম আর ইয়াদভ জনগোষ্ঠী -যাদের সম্মিলিতভাবে ‘এমওয়াই’ বলা হয়ে থাকে। নীতীশ কুমার ২০০৫ সালের নভেম্বরে যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন জেডিইউ-এর খুব একটা শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল না।
প্রবীণ সাংবাদিক অরুণ আশিস বলেন, বিহারের রাজনীতি সবসময়ই জাতভিত্তিক। কিন্তু নীতীশ কুমার বিহারকে জাতপাত থেকে শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির দিকে নিয়ে গেছেন। তিনি উন্নয়নকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করেন। এমন নয় যে, তিনি জাতিগোষ্ঠীগুলোকে সংগঠিত করেননি, তবে তাদের একত্রিত করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্য নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
সুরুর আহমেদ আরও বলেন, আপনি যদি লালু প্রসাদ যাদবের রাজনীতির দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন তিনি দলিত এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে যেতেন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা বলতেন। অর্থাৎ তার রাজনীতিকে তিনি ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যেতেন। কিন্তু নীতীশ কুমার কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেও নীতিগত পরিবর্তন আনেন। এটার তো একটা ইতিবাচক প্রভাব আছে।
লালু প্রসাদ যাদব যে জাতের, সেই যাদবদের জনসংখ্যা বিহারে ১৪ শতাংশ কিন্তু নীতীশ কুমারের জাতি -কুর্মিরা মাত্র ২.৮৭ শতাংশ। যদি কুর্মিদের সঙ্গে কৈরিদেরও যোগ করা হয়, তাহলে সংখ্যাটি প্রায় সাত শতাংশ হবে। কুর্মি-কৈরিরা বিহারের রাজনৈতিক ভাষায় ‘লব-কুশ’ হিসাবে পরিচিত।
কিন্তু নীতীশ কুমার শুধুমাত্র কৈরি এবং কুর্মি সম্প্রদায়কেই একত্রিত করেননি বরং নারী এবং অতি পশ্চাৎপদ জাতি গোষ্ঠীগুলোকেও সফলভাবে একত্রিত করেছেন। এবার জেডিইউ-এর প্রাপ্ত ভোট ১৯ শতাংশেরও বেশি।
নারীদের মধ্যে নীতীশ কুমারের প্রভাব
নীতীশ কুমার ‘অতি পশ্চাৎপদ জাতি’, ‘দলিত’ এবং নারীদের জন্য অনেকগুলো প্রকল্প শুরু করেছেন। পাটনার এএন সিনহা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের প্রাক্তন পরিচালক ডিএম দিওয়াকর বলেন, গত ২০ বছরে নীতীশ কুমার যে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন সেটাই তার ভোটের ভিত্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। নারীদের জন্য সাইকেল এবং পোশাকের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজের ভোট ব্যাংকে নারীদের অংশীদারিত্ব বাড়িয়েছেন।
দিওয়াকর বলেন, যে নারী ২০১০ সালে নীতীশ কুমারকে ভোট দিয়েছিলেন, এখন তার মেয়েও সেই তাকেই ভোট দিচ্ছেন। এক অর্থে একাধিক প্রজন্ম নীতীশ কুমারকে পছন্দ করছেন।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় যে কাজটি নীতীশ কুমার করেছেন, তা হলো কর্পূরী ঠাকুরের মতোই তিনি ‘অতি পশ্চাৎপদ’ এবং ‘মহাদলিত’ জাতির জন্য ক্রমাগত কাজ করেছেন। জনসংখ্যার দিক থেকে এই দুই জাতি একটি বড়ো ভোট ব্যাংক। এর ফলে এই জাতিগুলো নীতীশ কুমারের পক্ষে একত্রিত হয়ে গেছে।
তৃতীয়ত, বিহারে জাতিগত জনগণনা শুরু করা। বিজেপি ক্রমাগত এই জনগণনার বিরোধিতা করছিল, কিন্তু নীতীশ কুমার তা সম্পন্ন করেন এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করলে দেখা যাবে এনডিএ জোটের কাছে নীতীশ কুমার এখন একটা বাধ্যবাধকতা হয়ে উঠেছেন।
এই নির্বাচনে ভোটদান নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব ছিল ‘জীবিকা দিদি’দের ওপরে।
নীতীশ কুমারের সরকার যেভাবে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করে এক কোটি ৪০ লাখ ‘জীবিকা দিদি’কে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছেন, তাতেও নারীরা নীতীশ কুমারের পক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন।
বয়স বাড়ছে নীতীশ কুমারের
নীতীশ কুমার একসময় ‘সুশাসন বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এখন তার বয়স ৭৫ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু দশম বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়া নীতীশ কুমার কতদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন তা নিয়েও জল্পনা চলছে। এই প্রশ্নে মানুষের মধ্যে একাধিক মত রয়েছে।
নালন্দা জেলার চন্ডি এলাকার ‘জীবিকা দিদি’ গীতা দেবী বলেন, ‘নীতীশ কুমার আমাদের জন্য সবকিছু করেছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। আমরা এই আশা নিয়েই তাকে ভোট দিয়েছি।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সরিতা কুমারী বলেন, সংবাদমাধ্যমে সবাই বলছে যে তিনি অসুস্থ। নীতীশই কিন্তু প্রবীণদের ১১শ টাকা করে পেনশন দিচ্ছেন।
নীতীশ কুমারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সিওয়ান থেকে আসা বীর বাহাদুর বলেন, নীতীশ কুমার সব ইস্যু নিয়েই কাজ করেছেন। এবার তিনি কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেবেন এবং অভিবাসন বন্ধ করবেন।
সাধারণ মানুষের এসব মতামতের অন্যদিকে প্রবীণ সাংবাদিক সুরুর আহমেদ বলেন, নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন কারণ এনডিএ জোট তার নামেই ভোট পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি আরও কিছুদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন, কারণ আগামী বছর অনেক রাজ্যে নির্বাচন রয়েছে এবং বিজেপি চাইবে না একটা ভুল বার্তা যাক। বিজেপি তাই কিছুদিন অপেক্ষা করবে।
তবে তথ্য বলছে, নীতীশ কুমারের ২০ বছরের শাসনকালে মানব উন্নয়ন সূচকে বিহারের অবস্থান একেবারে নিচে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, শিল্প এবং মাথাপিছু আয় প্রতিটা ক্ষেত্রেই অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে বিহার।
এরপরেও ২০২৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নীতীশ কুমারের শাসনের বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর কাজ করেনি। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে যে বিহারের রাজনীতিতে কি নীতীশ কুমারের বিকল্প কেউ নেই?
ডিএম দিওয়াকর বলেন, জনগণই এই বিকল্প বেছে নেবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতন্ত্রে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভোট কেনা হচ্ছে। এবারও নির্বাচনের সময় লাখ লাখ নারীর অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। স্পষ্টতই এর ফলে শাসক দল লাভবান হয়েছে।
টিটিএন
What's Your Reaction?