বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বরিশাল মহানগর বিএনপির

23 hours ago 4

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বরিশাল মহানগর বিএনপির। একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সমালোচনার সৃষ্টি করছেন কমিটির পদধারী নেতারা। গত পাঁচ আগস্টের পর কখনো বাসস্ট্যান্ড এবং বাজার দখল, কখনো সালিশ করে কমিশন আদায়, মামলা বাণিজ্য, আবার কখনো নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই হামলা-মামলায় জড়াচ্ছেন তারা। 

সর্বশেষ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির চার নম্বর যুগ্ম-আহ্বায়ক হালিম মৃধার ওপর হামলা এবং একই কমিটির সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীদের মানববন্ধন আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এসব ঘটনার দায় নিতে নারাজ আলোচনায় উঠে আসা বরিশাল মহানগর বিএনপির নেতারা। তাদের দাবি অভ্যন্তরীণ গ্রুপিংয়ের পাশাপাশি মহানগর বিএনপির কাউন্সিল ঘিরে অপরাজনীতির শিকার হচ্ছেন তারা।

দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, মহানগর বিএনপিতে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। বিতর্কের শুরুটা ছিল মনিরুজ্জামান খান ফারুককে এবং মীর জাহিদুল কবির জাহিদকে সদস্য সচিব করে কমিটি গঠনের পর থেকেই। আওয়ামী সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে না পারা এ কমিটির নেতারা জড়িয়ে পড়েন ‘কমিটি বাণিজ্যে’। অভিযোগ রয়েছে গণ আন্দোলনের সময় হামলা-মামলার ভয়ে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের বাড়িতে আত্মগোপন করেন সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ। এমনকি গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট নানকের বাড়িতে হামলা করতে যায় বিক্ষুব্ধ জনতা। সেই হামলা ঠেকাতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মীর জাহিদ এবং জেলা যুবদলের একজন নেতা।

এদিকে, ফারুক-জাহিদ নেতৃত্বাধীন কমিটিতে থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন ওই কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক জিয়াউদ্দিন সিকদার ও সদস্য আফরোজা খানম নাসরিন। কমিটির অন্যসব নেতারা যখন আত্মগোপনে, তখন বরিশালে আন্দোলন জমিয়ে রাখেন তারা। এ কারণে দলে মূল্যায়ন বাড়ে তাদের। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যেই মহানগর বিএনপির পূর্বের কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র থেকে। ৭ জুলাই ঘোষিত সেই কমিটিতে মনিরুজ্জামান খান ফারুককে আহ্বায়ক পদে বহাল রাখলেও সদস্য সচিব পদে পদোন্নতি হয় জিয়াউদ্দিন সিকদারের। 

এরপর গত ৪ নভেম্বর ঘোষণা হয় মহানগরের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি। এ নিয়ে বিতর্ক যেন আরও তুঙ্গে ওঠে। কেননা মহানগরের বাসিন্দা নয়, জেলা কমিটির সদস্য এমন নেতাদের দেওয়া হয় মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সদস্য পদ। আবার গত ১৭ বছরে বিএনপির ছায়া না মাড়ানো ব্যক্তি এবং আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদেরও কমিটিতে রাখা হয়। অথচ কমিটিতে রাখলেও অবমূল্যায়ন করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আলম ফরিদের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের। সেই ক্ষোভে বিভক্ত হয়ে যায় ৪২ সদস্য বিশিষ্ট মহানগর বিএনপির নেতারা।

এদিকে, বিএনপির তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, শুধু কমিটিতেই নয় বরং গত পাঁচ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর আরও নানান বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন মহানগর বিএনপির বর্তমান এবং পদপ্রত্যাশী নেতারা। তাদের বিরুদ্ধে একে একে উঠে আসে হিন্দুর সম্পত্তি, বাসস্ট্যান্ড দখল, মামলা বাণিজ্য এবং নিজ দলের নেতাদের ওপর হামলার অভিযোগ।

দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক ছিলেন না সরকার বিরোধী আন্দোলনে। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর আওয়ামী লীগের পতানো নির্বাচনের প্রতিবাদে অবরোধ শুরুর দ্বিতীয় দিন নগরীর সিএন্ডবি রোডে সাজানো আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন ফারুক। সেই থেকে আন্দোলনের পুরোটা সময় ঢাকা এবং বরিশালের কয়েকটি মামলায় কারাগারেই থেকে যান তিনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর মুক্ত হন ফারুক। এরপরই জড়ান সালিশ বিতর্কে। সালিশি করে তার টাকা দাবি করার একটি কল রেকর্ডও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

অপরদিকে, পাঁচ আগস্টের পর রূপাতলী বাস মালিক সমিতি এবং বাসস্ট্যান্ড দখলের মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বিএনপির শোক র‌্যালিতে হামলা করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা করেছেন হামলায় আহত মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক ও সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। দুটি মামলার একটিতেও আসামি করা হয়নি রেল দুর্নীতিতে আলোচিত ও সাবেক মেয়র প্রার্থী সালাউদ্দিন রিপন, মহানগর যুবলীগের আলোচিত যুগ্ম আহ্বায়ক মাহামুদুল হক খান মামুন, ১৯৯৬ এর ত্রাস রফিকুল ইসলাম খোকন, মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুর করিম, জিয়াউদ্দিন সিকদারের চাচা শ্বশুর কাওসার হোসেন শিপন, রবিউল কবির স্বপনসহ আওয়ামী লীগের আলোচিত আরও বহু নেতা। 

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের উল্লিখিত নেতাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে মামলার আসামি করা হয়নি তাদের। এমনকি আদালতে দাখিল করা মামলা থানায় যেতেই টাকার বিনিময়ে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় অর্ধশত আসামির নাম।

গত ৪ জানুয়ারি নগরীর রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হামলার শিকার হন মহানগর বিএনপির ৪ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক হালিম মৃধা। তার অভিযোগ হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদারের নেতৃত্বে ঘটে এ হামলার ঘটনা। এ ঘটনার প্রতিবাদে ৫ জানুয়ারি নগরীর সদর রোডে অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে মানববন্ধন করেন মহানগর বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা। তাছাড়া হামলার ঘটনায় জিয়াউদ্দিন সিকদার ও তার লোকেদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন হালিম মৃধা। যদিও এ ঘটনার পর মহানগর বিএনপিসহ অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জিয়াউদ্দিন সিকদারের পক্ষে নিন্দা ও প্রতিবাদ বিবৃতি দিয়েছেন। তার আগে গত ৫ আগস্ট নগরীর বটতলা এলাকায় বিএনপির এক কর্মীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর এবং দখল করেন সাবেক সদস্য সচিব ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী মীর জাহিদ।

অপরদিকে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী বলে ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক কেএম শহিদুল্লাহ। আওয়ামী সরকার বিরোধী আন্দোলনে যার ভূমিকা নেই বললেই চলে। বরং ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর নগরীর একাংশের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, সিটি করপোরেশনের আইন লঙ্ঘন করে কীর্তনখোলা নদীর তীরে ড্রেজিং পাইপ বসিয়ে বালুর ব্যবসা, হাসপাতালের সামনে কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তালা ঝুলিয়ে দেন তিনি। দখল করতে গিয়ে কীর্তনখোলী নদীর তীরে স্টেডিয়াম কলোনীবাসির হামলার শিকার হন তিনিসহ তার অনুসারীরা। এছাড়াও দলের নাম ভাঙিয়ে একের পর এক অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিতর্কে জড়ান মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ তাদের অনুসারীরা। দলটির স্থানীয় নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডে বিবৃত এখন নগরবাসী। দায়িত্বশীল পদে থেকে নেতাদের এমন কর্মকাণ্ড এবং অভিযোগের বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন দলের নীতি-নির্ধারকরা। এমনটা প্রত্যাশা বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের।

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক এবং বরিশাল বিভাগের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তারা ফোন রিসিভ হয়নি।

তবে মহানগর বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন কালবেলাকে বলেন, সম্প্রতি মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক হালিম মৃধার ওপর পেটোয়া বাহিনী দিয়ে যে আঘাত হানা হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। হালিম মৃধা দলের জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ। এমন ঘটনায় দলের ওপর অবশ্যই খারাপ প্রভাব পড়ে, দলের বদনাম হয়। বিষয়টি আমরা আমাদের মত করে দলের হাইকমান্ডে জানিয়েছি। এর বেশি কিছু তো আমাদের করার নেই।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, এখানে নেতৃত্বের অভাব এবং রাজনৈতিক শিক্ষা, অ্যাকাডেমিক শিক্ষারও অভাব রয়েছে। এ কারণেই দলের মধ্যে গোলমাল হচ্ছে। আর এজন্য দলের মধ্যে প্রভাব আসবেই। বিষয়গুলো দলের চেয়ারম্যানের কাছে, হাইকমান্ডের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা মনে হয় এদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি বলেন, ইতোপূর্বে আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয়েছে। আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ তিন মাসের। মূলত সম্মেলন প্রস্তুতির জন্য কনভেনিং কমিটি করা হয়। এখন কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কেউ কেউ এর বিরোধিতা করছে। আমি মনে করি সম্মেলন এবং কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হলে এই সমস্যাগুলো আর থাকবে না। এতে নেতৃত্ব এবং নেতার জনপ্রিয়তা কতটুকু তাও বোঝা যায়।

Read Entire Article